গল্প: বিশ্ববিদ্যালয় যখন স্বপ্ন দেখে – ডি এইচ শিশির

বিশ্ববিদ্যালয় যখন স্বপ্ন দেখেগল্প: বিশ্ববিদ্যালয় যখন স্বপ্ন দেখে

ডি এইচ শিশির

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেপুটেডেড একটি ডিপার্ট্মেন্টের বিফোর ইয়ারলি রেজাল্ট পাবলিশিং বোর্ড মিটিং এ আলোচনা চলছে। মাথার উপরে ঝুলে থাকা ঝাড়বাতি কোমল আলোয় ভরিয়ে দিয়েছে হলরুম, গ্লাস দ্বারা সুসজ্জিত ঝকঝকে ডেস্কের ফুলদানিতে রাখা ফুলগুলোও ছড়াচ্ছে সুগন্ধ। এইমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় গার্ডেন থেকে সজীব, তাজাতাজা ফুলগুলো এনে রাখা হয়েছে; এখনো শিশির জমে আছে পাপড়িতে। কথা চলছিল, একপর্যায়ে ‘ফিরে দেখা বছরজুড়ে অর্জনগুলো’ নামের এজেন্ডা শুরু হলো। এই টপিকের শুরুতেই একজন আলোচিত ছাত্রকে নিয়ে সমালোচনা শুরু হলো। ছেলেটি এবার সম্মান দ্বিতীয় বর্ষে পদার্পণ করতে যাচ্ছে। আজকে যেমন সে সমালোচিত হচ্ছে ঠিক ছয়মাস পূর্বে আজকের মতো দিনে টিচারদের কাছে সে আলোচিত ছাত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। অধ্যাপকগণ খুব আশাবাদী হয়েছিলেন তার মেধার স্বাক্ষর দেখে। সকল রেজাল্টকে পিছিয়ে ফেলে প্রথম হওয়ার মাধ্যমে সে হয়ে উঠেছিল পুরো বিশ্ববিদ্যালয়েরই স্বপ্ন। আউট অফ ফোর এ ফোর পাওয়া সত্যিই কোনো ছোট ব্যপার ছিল না কিন্তু সেই ছাত্রই যখন এ প্লাস থেকে বি তে নেমে আসে তখন স্বপ্নের ঘোর কাটে, থমকে যায় প্রত্যাশার পূর্ণতা প্রাপ্তির সম্ভাবনা।

ডিপার্টমেন্ট চেয়ারম্যান এবিষয়ে গঠনমূলক মন্তব্যের আহ্বান জানান। কয়েকজন টিচার নিজনিজ মন্তব্য করলেন এবিষয়ে। সবশেষে দাঁড়িয়েছেন তরুণ সহযোগী অধ্যাপক ডক্টর আহমেদ তানজিম। পুরো হলরুমে পিনপতন নীরবতা নেমে এসেছে। আহমেদ তানজিম এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই সাবেক মেধাবী ছাত্র। সম্মান শ্রেণি শেষে ইউরোপের দেশ থেকে মাস্টার্স ও পি এইচ ডি করে এসে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। ছাত্রাবস্থা থেকেই টিচারদের কাছে স্নেহের মুখ আহমেদ তানজিম। বক্তব্যের সময় অনেক সুন্দর করে কথা বলেন বলে সবাই তাঁর মুগ্ধশ্রোতা হয়ে যান। সালাম দিয়ে তিনি তাঁর কথা শুরু করলেন।
‘আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক এবং সহকর্মীবৃন্দ, আমি আজ এই মিটিং এ যোগদানের পূর্বেই আলচ্য বিষয়ে পূর্ণাঙ্গভাবে স্টাডি এবং গবেষণা করে এসেছি। তার আগে কথা বলেছি আমাদের এই আলোচিত এবং সমালোচিত ছাত্র তানভীর হাসান এবং তাঁর সিনিয়র ব্যাচের কিছু ছাত্রের সাথে। আপনারা ভীষণভাবে বিস্মিত হবেন তাদের বদলে যাবার কারণগুলো জানলে।’

সবাই একটু নড়েচড়ে বসলেন। একজন সিনিয়র অধ্যাপক বললেন, ‘জনাব আহমেদ তানজিম, কি সেই কারণ বলুন? যার জন্য আমাদের কোমলমতি স্টুডেন্টস তাদের সুন্দর ক্যারিয়ার নিয়ে অসচেতন হয়ে পড়ছে।’ উনি একটু শ্বাস নিলেন তারপর বললেন, ‘ইন্সট্যান্ট ভিজিটিং- এ আমাদের মাননীয় ভাইস চ্যান্সেলর স্যার এখনই ডিপার্টমেন্টে আসছেন। কিছু সময়ের মধ্যেই হল রুমে প্রবেশ করবেন। আপনি আপনার গবেষণালব্ধ তথ্যগুলো উনার সামনেই উপস্থাপন করুন, তাহলে সমস্যা এবং সম্ভাবনা নিয়ে আলাপআলোচনা শেষে আমরা এ থেকে উত্তরণের কোনো পথ খুঁজে পেতে পারি।’ উনার কথা শেষ হতে না হতেই উপাচার্য মহোদয় হল রুমে প্রবেশ করলেন।অভ্যর্থনা শেষে ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান উপাচার্যকে সংক্ষিপ্তাকারে আলোচনার বিষয়বস্তু জানালেন। সব শুনে উনি খুবই আগ্রহের সাথে জনাব আহমেদ তানজিমকে অনুরোধ করলেন তার গবেষণা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরতে। উনি আল্লাহর উপর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আবার শুরু করলেন, ‘আমি রেজাল্টের এমন খারাপ অবস্থা জানার পর প্রথমে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করি সেই ছাত্র তানভীর হাসানের সাথে। ও জানালো সবচাইতে বড় সমস্যা হলো বিপরীত লিঙ্গের সাথে রিলেশন ঘটিত জটিলতা নিয়ে সে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। আমি এ ব্যপারে গভীরভাবে জানার জন্য কথা বলেছি আরও ছাত্রছাত্রীর সাথে। তাদের বেশিরভাগই একইধরনের সমস্যা ফেইস করেছে। কিছুক্ষেত্রে তাদের সমস্যার সুত্রপাত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন উপসর্গ থেকে তবে চারিত্রিক অবক্ষয়তাই হলো মৌলিক।
স্যার, খেয়াল করুন, লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর মাঝ থেকে আমরা মাত্র কয়েকজনকে বাছায় করে নিয়েছি। তাদের সবাই মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলো। তাহলে ভর্তি পরবর্তী সময়ে মাত্র কয়েকজনের রেজাল্টই কেন আমাদের মুখ উজ্জ্বলের পাথেয় হিসেবে আবির্ভূত হয়? তাদের সবাই তো অসাধারণ মেধার সক্ষমতা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। এর কারণ হলো ‘নৈতিকতার শূন্যতা’। হ্যাঁ, প্রাথমিকভাবে এটাকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে না হলেও এটাই হচ্ছে একদম মৌলিক সমস্যার একটি।’ একনাগাড়ে কথাগুলো বলে একটু শ্বাস নিতে থামলেন তিনি।
এতক্ষণ গভীর মনযোগ সহকারে বক্তব্য শুনছিলেন উপাচার্য মহোদয়। তাঁর থামার সুযোগে কথা বলে উঠলেন, ‘দুঃখিত জনাব আপনার আলোচনার মাঝেই প্রশ্ন করার জন্য। প্রশ্ন হলো, একইভাবে তো তারা এপর্যন্ত আসতে পেরেছে তাহলে এখন কীভাবে এটাই মৌলিক সমস্যার সৃষ্টি করছে?’
‘ধন্যবাদ স্যার, গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করার মাধ্যমে আমার কথাগুলো এগিয়ে নেবার সুযোগ করে দেবার জন্য। আমার মতে, এর কয়েকটি কারণ রয়েছে , প্রথমত, হতে পারে তাঁরা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত থাকাকালীন সময়ে তাদের পিতামাতার নিবিড় পরিচর্যায় থাকার কারণে এধরণের অনৈতিকতাকে এড়িয়ে চলেছে কিন্তু এখন বিশাল দিগন্তে মুক্ত বিচরণের সুযোগ পেয়ে তারা নৈতিক চরিত্রের সেই ভারসাম্য হারিয়ে সবধরনের মানুষের সাথে মিশে শিক্ষার অবারিত সুযোগের অপব্যবহার করছে। আর বড় আশঙ্কার কথা হলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জিত আচার-আচরণের শিক্ষাই প্রতিফলিত হয় তাদের জীবনের নিকটতম অধ্যায় ক্যারিয়ার বা পেশা জীবনে। তাই এখান থেকে শুরু আমরা এখনই সচেতন না হতে পারি বিভিন্ন ধরনের অনৈকতায় ছেঁয়ে যাবে দেশের সবধরনের গুরুত্বপূর্ণ জব সেক্টর। ব্যহত হতেই থাকবে জাতীয় শৃঙ্খলা।’
‘ধন্যবাদ জনাব আহমেদ তানজিম, আপনার এই পয়েন্ট একটা গুরুত্বপূর্ণ ইনডিভিজুয়াল দৃষ্টিভঙ্গি এবং ব্যর্থতার আভাস প্রতীয়মান করে তুলছে। আমরা শিক্ষার্থীদেরকে তাদের পিতামাতার নিবিড় পরিচর্যা থেকে আহরণ করেছি কিন্তু তাদের সেই ধরনের শিক্ষাকে মূলধারায় এগিয়ে নিতে যেমন পাঠ্যক্রম থাকা আবশ্যক ছিলো তেমন কোনো পদক্ষেপ আমরা নিতে পারিনি। যার কারণে তারা এধরণের ভারসাম্যহীনতায় পড়েছে।’

‘ধন্যবাদ! আপনি ঠিকই বলেছেন জনাব উপাচার্য’, উপাচার্যের কথা শেষ হতেই অপর একজন প্রবীণ অধ্যাপক উঠে দাঁড়ালেন, ‘আপনারা একটু কল্পনা করুন, বর্তমান সমাজে চারিত্রিক অবক্ষয়ের জন্য কত ধরণের উপাদান একদম তাদের হাতের নাগালে এনে দেওয়া হয়েছে যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো যায়গায় তাদের পরিবার থেকে পেয়ে আসা তেমন নিবিড় পরিচর্যা আমরা ততটা সহজলভ্য করে দিতে পারিনি। আমাদের প্রিয় শিক্ষার্থীদের মধ্যেই তো আপনার আমার সন্তানের প্রতিচ্ছবি রয়েছে, আমাদের আদরের সন্তানেরাও হয়ত আমাদের থেকে দূরে কোনো শিক্ষাঙ্গনে বসে ছোট বেলা থেকে পাওয়া সুন্দর জীবন গড়ার জন্য ছোট্ট ছোট্ট সেই মোরাল শিক্ষাগুলো আর না পাওয়ায় সমাজের প্রতিক্ষীত পথ থেকে ছিটকে পড়ছে, নীতিনৈতিকতা হারাচ্ছে; অথচ এরাই হবে আগামীর কর্ণধার। তাই তাদেরকে এই সাপোর্ট আমাদেরকেই দিতে হবে, বোঝাতে হবে একজন মানুষ হিসেবেও এর প্রয়োজনীয়তা কত বেশি। আর এভাবে একজন নয় আমাদের প্রত্যেকটি ছাত্রছাত্রী হয়ে উঠবে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন।’

আলোচনা চলল আরও অনেকক্ষণ। উপাচার্য মহোদয় অধ্যাপক আহমেদ তানজিমসহ আরও কয়েকজন প্রফেসরকে দায়িত্ব দিলেন এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে একটা তথ্যবহুল রিসার্চপেপার তৈরির জন্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরবর্তী সিন্ডিকেটে এটার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেবার জন্য যাবতীয় চেষ্টা তার পক্ষ থেকে করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন।

Share with Friends

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top