হজরত শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে ইউএসএ এয়ারলাইন্সের একটি বিশেষ বিমানে বসে আছি। জীবনে প্রথমবার বিমান ভ্রমণ করতে চলেছি, সে জন্য যতটা না এক্সাইটেড তার চাইতে বেশি কিউরিসিটি অনুভব করছি। উৎকণ্ঠায় কাটছে প্রতিটি মুহূর্ত।
কারণটা অবশ্য বেশ অস্পষ্টতার চাদরে ঢেকে আছে। গত এক মাস আগের কথা, আমাদের বাসার সামনে পুকুর পাড় লাগোয়া ছোট্ট একটা ফুলের বাগান আছে, সেখানে বসে আছি। ঠিক তখন দেখলাম আফিয়া (আমার স্ত্রী) প্রবেশ করলো সাথে দু’জন অচেনা আগন্তুক। তাদের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, তারা আমার জন্য একটা নিমন্ত্রণপত্র নিয়ে এসেছে। এটা নিশ্চয়ই আমার জন্য কোনো অবাক করা ঘটনা হতে পারে না। কারণ, দেশের একটা নামকরা কলেজের প্রিন্সিপাল হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন স্থান থেকে নানান রকম অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যাওয়ার সুযোগ হয়। কিন্তু এবার আর অভ্যন্তরীণ, জাতীয় পর্যায় নয়, একেবারে ইন্টারন্যাশনাল নিমন্ত্রণ পাওয়াতে আমার মতো নগণ্য মানুষের কৌতূহলের শেষ থাকে না। তাদের সাথে কথা বলে এও জানতে পারলাম যে, এই নিমন্ত্রণ করেছে সুদূর আমেরিকার বৈজ্ঞানিক অর্গানাইজেশন ‘নাসা’ থেকে আমার একটা স্টুডেন্ট। শুধু স্টুডেন্ট বললে বেশ ভুল হবে। সে আমার অনেক প্রিয় একটা স্টুডেন্ট ছিল একটা সময়।
সব কিছু ঠিক ঠাক এখন শুধু আমার মতামতের অপেক্ষায় আছে সবাই। বাসার সবার উৎসাহে রাজি হয়ে গেলাম সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারের পাশ্চাত্য দেশে সম্মানজনক সফরের জন্য। ইতোমধ্যে বিমান পাখা মেলে উড়তে শুরু করলো দিগন্তের মুক্ত নীল-নীলিমায়। জানালার পাশ দিয়ে উড়ে চলেছে পেজা তুলোর মতো কোমল দেখতে, জমাটবাঁধা শুভ্র মেঘমালা। ইচ্ছে করছে হাতের আলতো স্পর্শে আদর করে দিতে কাচের ওপাশে থাকা গাঢ়ো নীল নীলাভকে। পৃথিবীর উপরি ভাগের এই লুক্কায়িত সৌন্দর্যের মায়াজালে আটকে গেলো আঁখি যুগল! আর সময়ের অতল গভীরে প্রবেশ করতে শুরু করলো মনুষ্য নিয়ন্ত্রণের বাহিরে থাকা অবচেতন হৃদয়। স্মৃতির পাতা ঘেঁটে বের করলো অতীত সময়ে ঘটে যাওয়া একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনার ধুলো জমে মরিচা ধরা একটা ফ্রেম। ঘটনাটা এমন হৃদয়স্পর্শী ছিলো যে, সহজে ভুলে যাওয়ার কথা ছিলো না। তবুও ভুলে গেছিলাম; সময়ের চাকা, ব্যস্ততার সীমাহীন চাপে অতীতের ডায়েরিতে স্তূপাকার স্মৃতির মাঝে চাপা পড়ে ছিল এতদিন। তারপরেও দেখছি সেটা চিরতরের জন্য মুছে যায়নি, ছায়ালিপি হয়ে রয়ে গেছে মস্তিষ্কের কোনো এক সঞ্চয় কোষে; ডায়েরির সেই পাতাটিতে।
ঘটনাটা আজ থেকে কয়েক বছর আগে ঘটেছিল… তখন আমি বি, সি, এস কমপ্লিট করে সবে মাত্র একটা সরকারি কলেজের ইংরেজির লেকচারার হিসেবে জয়েন করি। একদিন ক্লাস শেষ করে বের হচ্ছিলাম তখন হঠাৎ করেই খেয়াল করলাম ঐ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এই অল্প দিনের পরিচয়ে আমার সবচাইতে প্রিয় ছাত্রটি ছলছলে উদাসী নয়নে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। যদিও ঘটনাটা ছিলো একেবারেই স্বাভাবিক কিন্তু কেন যেন মনে ইঙ্গিত করছে অস্বাভাবিকতার দিকে। তাকে ক্যাম্পাসের নিরিবিলি একটা জায়গায় এনে জানতে চাইলাম এমনভাবে থাকার কারণ। সে ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর ছোট্ট ছোট্ট বাক্যে সব কথা বলতে লাগলো পরম নির্ভরতায়। তার কথা শুনে আমি খুব ব্যথিত হলাম! তার প্রত্যেকটা হৃদয়বিদারক কথা সুঁচের মতো আঘাত হানছিলো আমার কোমল হৃদয়ে। একটা ছেলে শুধুমাত্র টাকার অভাবে শেষ করে দিতে চলেছে তার ক্যারিয়ার, স্বজনদের কাছ থেকে একটু সহানুভূতি পাওয়ার আকাক্সক্ষাতেও ভর করেছে অসীম দুবর্লতা। আগামীর একটা সম্ভাবনাময় দীপ্ত চন্দ্রকীর দুঃসময়ে যখন তার পাশে দাঁড়ানো, তাকে উৎসাহ দেয়া তার স্বজনদের জন্য ছিলো অবারণীয়। ঠিক সেই মুহূর্তে সুশীলসমাজের ঐ মানুষগুলো ভ্রু কুঁচকে একরাশ তাচ্ছিল্য সহকারে তাদের অপারগতা প্রকাশ করেন। তারা হয়তো বুঝেও না বুঝার ভান করেছেন শুধুমাত্র কার্পণ্যতার কারণে। কিন্তু তারা হয়ত বুঝতে পারেননি শুধুমাত্র এতোটুকুই যথেষ্ট ছিলো উপহাস করে একটা অবন্ধ প্রত্যাশী তরুণের হৃদয় ভেঙে দেয়া আর তাকে তার প্রতীক্ষিত সম্ভাবনাময় সিঁড়ির প্রথম ধাপ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে হতাশার প্রকোষ্ঠে প্রজ্বলিত করার জন্য। আমি দেখেছি তার চোখ বেয়ে মৃদু গতিতে নেমে চলা জলকণা চিৎকার করে ধিক্কার দিচ্ছে ঐ সমস্ত মানুষকে যারা তাকে নিভৃতে পীড়ন আর দরিদ্রতার উপহাস করেছে। আমার চোখে আরও এসে ধরা দিলো তার সম্মুখে চলার একাগ্রতা যেটা সমসাময়িক বাধা পেয়ে স্মিত হয়ে আছে। আমার ভেতর থেকে নাড়া দিয়ে উঠল স্বীয় মনুষ্যসত্তা। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম একটা মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের। ছেলেটার ছোট্ট কাঁধে হাত রেখে চোখের ভাষায় বোঝালাম যার কেউ নেই তার আল্লাহ্ আছেন। আর যার সাথে স্বয়ং তিনি আছেন সকল বাধা বিপত্তি তার কাছে নস্যি। চেয়ে দেখলাম তার চোখ থেকে আবারো পানি ঝরতে শুরু করলো.. টপ টপ করে পড়তে লাগলো নিচের ধূলিকণার ওপর।
উপরওয়ালা তাকে যতটুকু সাহায্য করার তাউফিক দিয়েছিলেন প্রাণপণে চেষ্টা করেছিলাম অন্তত ততটুকু করার। এরপর সে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সেই বছরের বোর্ড সেরা তিনজনের মধ্যে একজন হয়েছিলো। সেদিন ও আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলো। আমিও ওকে লুকিয়ে চোখ থেকে ঝরিয়ে ছিলাম নোনা পানি। রক্তের বাঁধন নেই, নেই কোন সম্পর্ক। তবুও সেদিন শুধু একটি কথাই মনে হয়েছিলো যে, আত্মার সম্পর্ক থাকলেই তো তাকে আত্মীয় বলে তবে সে কেন আমার আত্মীয় হতে পারে না! আর যদি না হয় তবে লুটিত এ পানির রহস্য কী? সেদিন প্রশ্ন ছিলো, উত্তর ছিলো না। আর খুঁজতেও মন চায়নি। কিছু উত্তর অজানা থাকাই শ্রেয়। তবে অনেক বেশি চেষ্টা তদবির করে ওর জন্য সরকারি একটা মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করেছিলাম; যাতে করে ওর সমস্যাগুলোর কিছুটা হলেও সমাধান হয়।
তারপর থেকে বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন কলেজে বদলির সুবাদে আর পারিবারিক ব্যস্ততার কারণে ওর সাথে আর দেখা সাক্ষাৎ করার সুযোগ হয়নি। তার সমস্ত স্মৃতি, মস্তিষ্ক নামের ডায়েরির পাতায় নিষ্ক্রিয় হয়েছিলো এতোদিন। কিন্তু হঠাৎ করেই শেষ বয়সে এসে এভাবে ছোট্ট সেই নিষ্পাপ মুখটি আবার দেখার সুযোগ হবে ভাবিনি কখনো।
নিউ ইয়র্ক এয়ারপোর্ট থেকে নাসার ব্যক্তিগত হেলিকপ্টারে করে আমাকে নেয়া হলো তাদের সদর দফতরে। আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষকে ঘিরে এতোবেশি আয়োজন দেখে আমি রীতিমত বিস্মিত। বিস্ময় আমাকে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মতো চঞ্চল করে দিচ্ছে। অবশেষে আমার সাথে দেখা করানো হলো বাংলাদেশের কৃতী সন্তান, নব তরুণদের জন্য উৎসাহের বাস্তব দৃষ্টান্ত; সেদিনের শিশিরের বর্তমান রূপ তরুণ বিজ্ঞানী আহমেদ শিশিরের সাথে। যাকে ঘিরে আজ এতো আয়োজন। সেদিনের সেই কিশোর আর আজকের এই যুবকের মধ্যে বিস্তর তফাত। মিল আছে একটিই আর তা হলো সেই চোখের পানি আর পানির সেই নিশ্চুপ ভাষা। উপস্থিত সকল অতিথি নিশ্চুপ অবলোকন করছে দুই বাঙালি শিক্ষক-ছাত্রের হৃদয়ের পূর্ণতার মিলন। পুরো অডিটোরিয়াম জুড়ে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। অবশেষে বেজে উঠলো সাউন্ড। আমাকে সম্মানের সাথে আসন গ্রহণ করতে বলা হলো। তারপরে অনেকক্ষণ ধরে চললো আনুষ্ঠানিকতা।
এতক্ষণ ধরে সবার বক্তব্য শুনে যতটুকু বুঝতে বাকি ছিলো ততটুকুও বুঝতে পারলাম। দিনের আলোর মতো সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গেলো শিশিরের সমাপনী বক্তব্যে যার সবটাই ছিলো আমার জন্য তার প্রণিসম কৃতজ্ঞতা। আজ সবাই মিলে এখানে সমবেত হওয়ার একটাই কারণ, আর তা হলো আজ আমেরিকার গত এক বছরের সকল গবেষণার চুলচেরা মান বিশ্লেষণের পরে ‘এ বছরের সেরা বিজ্ঞানী অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করা হবে। আর এবার মহাকাশ গবেষণায় অনবদ্য ভূমিকা রাখায় তরুণ উদীয়মান বিজ্ঞানী আহমেদ শিশিরকে এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। আর তার ইচ্ছা এই পুরস্কারটি সে আমার হাত দিয়ে নিতে চায়। তার এই ইচ্ছাতে পুরো পৃথিবী বিস্মিত, বিস্মিত আমি নিজেও। ভেবে পাচ্ছি না এতো গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ থাকতে আমার মতো মানুষের হাত দিয়েই বা কেন নিতে হবে? তবে যাই হোক আনন্দের একটা ঢেউ খেলা শিহরণ জেগে উঠছে আমার মাঝে! কাল হয়তো সারা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি হবে। অসম্ভব আনন্দের উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়বে বাংলাদেশের বুকেও। এমতাবস্থায় খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে আমার প্রিয় ছাত্রটির মনে কিরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। আমার চোখ বাঁধভাঙা খুশির বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। এতটুকু বুঝতে পারছি যে, আমি সামান্য কর্তব্যটুকুই পালন করেছিলাম। কিন্তু এই ছোট্ট উপকারের এতো বিশাল প্রতিদান আমার সাত জন্মের কল্পনাকেও হার মানিয়ে দেয়। তাই আজ এই শেষ বয়সে এসেও এটাই রিয়েলাইজ করলাম যে, আমাদের ছোট্ট ছোট্ট উপকার যেমন সাহায্যপ্রত্যাশী মানুষগুলোর মুখে ফোটায় অকৃত্রিম হাসি তেমনি তার প্রতিদানও আমাদের কাছে ফিরে আসে এক পৃথিবী সমান পাওয়া নিয়ে। হয়ত তার চেয়েও বেশি কিছু। তা হয় ইহকালে নতুবা পরকালে; তবে আসবেই।
পাবলিস্টেড বাই ‘নতুন কিশোর কণ্ঠ’