অন্যদিগন্তের খোঁজে – ডি এইচ শিশির

অন্যদিগন্তের খোঁজে

শিরোনাম : ‘নষ্ট রাজনীতি : আক্রান্ত শিক্ষার্থী’

নাম: অন্যদিগন্তের খোঁজে

লেখক: ডি এইচ শিশির

১.

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান। প্রধান অতিথির আসনে উপবিষ্ট আছেন বাংলাদের সবকয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত চ্যান্সেলর (রাষ্ট্রপতি) । তিনি আজকের অনুষ্ঠান শুরুকরার ঘোষণা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। অল্পকিছু সময় বিশ্রাম নেওয়ার পর তিনি উঠে দাঁড়ালেন প্রাথমিক বক্তব্য দেওয়ার জন্য। অজস্র ফুলেরতোড়া দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে মঞ্চ। ফুলের মিষ্টি গন্ধের সাথে মিশ্রিত হয়েছে আনন্দের বাঁধভাঙা জোয়ার। খুশির বার্তা ছড়িয়ে পড়ছে অডিটোরিয়াম জুড়ে। শতশত ক্যামেরার ফ্লাশ একসাথে জ্বলে উঠলো। উনি শুরু করলেন বক্তৃতা। মঞ্চে আছেন সম্মানিত ভাইসচ্যান্সেলর সহ সকল আমন্ত্রিত অতিথিগণ। সামনে বসে আছে আজকের অনুষ্ঠানের মধ্যমণী, যাদের জন্য আয়োজিত হয়েছে এই মহতী অনুষ্ঠান সেই সমস্ত কৃতী ছাত্রছাত্রীগণ।

বক্তৃতা করছেন মাননীয় চ্যান্সেলর সাহেব। পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে অডিটোরিয়ামজুড়ে। সবাই খুব মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করছেন উনার ছোট্টছোট্ট দম ফেলে বলা কথাগুলো। বক্তৃতার একেদম শেষ প্রান্তে এসে চ্যান্সেলর সাহেব উনার লিখিত বক্তব্যের বাইরে পদাধীকারবলে কয়েকটি কথা বললেন । যে কথাগুলো পুরো অনুষ্ঠানের চিত্র বদলে দিল। উনার কথাটি বলতে দেরি পুরো অডিটোরিয়ামজুড়ে এক অন্যরকম খুশির জোয়ার বয়ে যেতে সময় লাগলো না। সবার সহাস্যমুখে মৃদু গুঞ্জনে মূখরতা দেখে হাস্যোজ্জলতার এক খণ্ড আলো দীপ্তিমান তারকার মত জ্বলে উঠলো রাষ্ট্রপতি মহাদয়ের মুখেও। উপস্থিত অতিথিগণ অবস্থা সম্পর্কে অবগত না থাকায় একজন অপরজনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছেন। তা বুঝতে পেরে সম্মানিত চ্যান্সেলর সাহেব বলেই ফেললেন ব্যাপারটা।

“দেখুন সম্মানিত উপস্থিতি, আপনারা যার সম্পর্কে জানার জন্য মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন তার সম্পর্কে আমি নিজেও কিঞ্চিৎ অবগত। গতকয়েকদিনে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়ে ভাইসচ্যান্সেল এবং বেশ কয়েকজন অধ্যাপকদের তাদের ছাত্রদেরকে উদ্দেশ্যকরে আকাঙ্খিতস্বরে বলতে শুনেছি ‘তোমাদের মধ্যেও গড়ে উঠুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ কৃতি ছাত্র শিশির খাঁনের মতো উন্নত চিন্তা চেতনা। আঁধারের নিরঙ্কুশ হাহাকারের মাঝে আলোর মশাল হাতে তার মতো তোমরাও বেরিয়ে পড় কোমল শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রশান্তির আলোকরশ্মি ছড়িয়ে দিতে।’ তো এছাড়াও অল্পকিছু শুনেছিলাম তার সম্পর্কে। তাই আজ এখানে আসার পর সেই কৃতি ছাত্রের সম্পর্কে কিছু না বলে পারলাম না।” ধন্যবাদ সবাইকে!

প্রেসিডেন্ট সাহেব উনার জন্য রাখা নির্দিষ্ট আসনে গিয়ে বসলেন। তারপর ভিসি সাহেবকে কানেকানে বললেন, ‘আমি ছেলেটার সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই এবং অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়ের মধ্যেই তার সম্পর্কিত ফাইল দেখতে চাই । বুঝেনই তো তার মতো কৃতি ছাত্র আমাদের দেশের জন্য আজ কত বেশি প্রয়োজন।” হাসি মুখে বললেন মিঃ প্রেসিডেন্ট। কিছুটা গর্বোজ্জ্বল চেহারায় অনুরূপ এক চিলতে হাসির রেখা টেনে ‘হ্যাঁ’ বোধক জবাব দিলেন ভিসি সাহেব।

২.

স্বপ্নের রাজ্যে প্রবেশ করার সিংহদ্বার এটি। ভবিষ্যতকে স্বপ্নিল রাজ্যের মতো সুন্দর, সুশৃঙ্খল, আর শান্তিঘেরা পুষ্পকাননের ন্যায় গড়তে যারা কঠোর পরিশ্রমী তারাই কেবল সাধনার উদ্দেশ্যে এখানে প্রবেশ করতে পারে। এটা রূপকথার কোন সাজানো গোছানো রাজ্য নয়, নয় কল্পনাবিলাসী মানুষের কল্পনা। এখানে রূপকথার পরীরা রাত দুপুরে রাখালের বাঁশির মনোমুগ্ধকর মিষ্টি সুরে আকৃষ্ট হয়ে ঐ দূর আকাশের নীল নীলিমার ওপারে থাকা তাদের দেশ থেকে নেমে আসেনা। কিন্তু অতুল পরিশ্রমের ফলে স্বপ্নগুলো বাস্তব হয়েই রূপকথার মতো ঠিকই ধরা দেই। রাজকুমার- রাজকুমারীরা পংখীরাজ ঘোড়ায় চড়ে আসে না। কিন্তু শত- সহস্র কোমলমতী শিক্ষার্থী নিত্য সাঁঝে রঙিন স্বপ্ন বুনতে থাকে বাস্তব এই জ্ঞান রাজ্যকে নিয়ে; এখানে ধুলি ধূসর পদার্পণের জন্য। এই জ্ঞান রাজ্য সর্বক্ষণ মুখর থাকে মাতৃস্বরূপ সুজলা- সুফলা বাংলার সমগ্র প্রান্ত থেকে উঠে আসা শ্রেষ্ঠ জ্ঞান পিপাসুদের পদচারণায়।

আজ নবীনবরণ অনুষ্ঠান হতে বের হলো একঝাঁক শিক্ষার্থী। সবার হাতে একটি করে গোলাপ আর দুটি করে রজনীগন্ধা ফুল দিয়ে তোড়াবাঁধা । অজস্র ফুল হতে সৌরভ ছড়িয়ে পড়ছে ক্যাম্পাসময়। এক অভিন্ন সুন্দর অনুভূতি বিরাজ করছে সর্বত্র। সারাদেশ থেকে উঠে আসা তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীদের এই সমাগম আর কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে আছে দেশশ্রেষ্ঠ এই বিদ্যাপীঠ।

হলঘর থেকে বের হয়ে আসা নবীন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সর্বদক্ষিণে একদল স্টুডেন্ট হাসাহাসি করতে করতে বের হয়ে আসছে। তারা কথোপকথনরত সবার মধ্যখানে নীলসার্ট পরিহিত সৌম্যদর্শন ছেলেটাকে ঘিরে। সবার হাতে শুধু ফুল থাকলেও ওই ছেলেটার হাতে রয়েছে বেশকয়েকটি গিফ্ট বক্স। এই ছেলেটিই এবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিযুদ্ধে প্রথম হয়েছে। আর সেবিষয়েই একটু একটু করে এগিয়ে চলছে তাদের কথোপকথন। ছেলটি সম্পর্কে তাদের জানার অদম্য আকাঙ্খা যেন শেষ হচ্ছে না। ছেলেটির নাম শিশির, শিশির খাঁন। নম্র- ভদ্র, লাজুক আর অতুলনীয় মেধার অধিকারী সে। মহান আল্লাহ যেন ভালোবেসে, অতি দয়া করে সমস্তগুণ গেঁথে দিয়েছেন ওর মধ্যে। শুভাকাঙ্খিরা বলেন যে আল্লাহ তায়ালা হয়ত শিশিরকে দিয়ে একদিন অনেকবড় কিছু করাবেন। এটা তাদের প্রত্যাশাও। বিশেষ করে অনেক বড় ঘরের সন্তান হওয়ার পরেও সহাস্যমুখে সবাইকে বুকে টেনে নিতে পারে শিশির। একজন রিকশাচালক তার কাছে বেশি সম্মান পেয়ে থাকে বড়বড় অফিসারদের তুলনায়। ওর যুক্তি একটাই ওদের সাথে থাকলেই নাকি আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ হয় বেশি। যেখানে আল্লাহকে পাওয়া যায়; যাদের সাথে থাকলে অপার্থিব জগতের সাথে সেতুবন্ধন তৈরি হয় তাদের সম্মান কখনওই এই বিলাসী পার্থিবতার সাথে এক হতে পারেনা।

মানুষের জন্য কিছু করার মাঝে ও জান্নাতি প্রশান্তি অনুভব করে তাই অপরের ডাকে সাড়াদিতে গিয়ে ও মাঝেমাঝে নিজের কথা ভুলে যায়। এজন্য মানুষের মাঝে থেকে তাদের সাথে নিজেকে মিশিয়ে যাতে তাদের দুঃখগুলো একটু নিজেও ভাগ করে নিতে পারে সেজন্য পিতার বিশাল সুখ সমৃদ্ধ বিলাসী বাসভবন থেকে চলে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।

হলেই উঠতে পেরেছে শিশির। কিন্তু এর জন্য তাকে অনেক ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়েছে। কারণ, দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ আজ পরিণত হয়েছে রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে। নিয়মানুসারে প্রতিবছর যেই পরিমাণে ছাত্রছাত্রী তাদের ছাত্রজীবন শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করবে ঠিক তৎসমপরিমাণ ছাত্রছাত্রী এসে উঠবে তাদের রেখে যাওয়া সিটে। এভাবেই চলার কথা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় চলে অন্যভাবে। এখানে আইন আছে, আইন যাদের উপর প্রয়োগ করার কথা তারাও আছে কিন্তু নেই সুষ্ঠুভাবে আইন প্রয়োগকারী কোন কর্তৃপক্ষ, প্রশাসন। কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা থাকলেও তথাকথিত ‘উপর মহলের চাপ’ বলে একটা কথা বলে তারা পাশ কাটিয়ে যান।

একদল মানুষের কাছে কুক্ষিগত রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার সকল আইন। তারা নিজ ইচ্ছামত সংশোধন করে প্রয়োজন মতো অপব্যবহার করে। তারা যা খুশি তা- ই করে আর কর্তৃপক্ষের কেউ নির্বাক দর্শক আবার কেউ কেউ তাদের প্রত্যক্ষ অথবা মৌনসমর্থনকারী। আর যারা এগুলো করে তারা একটি বিশেষ সম্প্রদায়ভুক্ত। ধার্মীক বা ধর্মভীরু কোন সম্প্রদায় এরা নয়; এরা বাইরে থেকে জনগণের সেবক নামের ব্যানারের আড়ালে রাজনীতির ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকা ছাত্রনেতা। এরা উপনিবেশবাদ সদৃশ ভূ আগ্রাসী নয় কিন্তু অনুরূপভাবে ক্ষমতা আগ্রাসন রোগে আক্রান্ত। আজ তার বিষাক্ত ছোবলে জর্জরিত সমাজ, জাতী, সহ সবকিছু। এরা বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে- ছিটিয়ে আছে আমাদের জাতীয় জীবনের প্রতিটি শিরা- উপশিরা, তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে। এদের কতক ছাত্রনেতা আছে যাদের ছাত্রত্ব শেষ হয়েগেছে দু’চার বছর আগে অথবা ইম্প্রুভ দিতে দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে কিন্তু ক্ষমতার জোরে সিট দখল করে বসে আছে। আর বিস্ময়কর মেধাবী, দেশরত্ন দরিদ্র ছাত্রছাত্রীগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিযুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ নিদর্শন রাখার পরও একটু বিনা খরচে আশ্রয়ের অভাবে, মেসে থেকে পড়াশুনা চালিয়ে যাবার অসামর্থ্যে তাদের লালিত স্বপ্নগুলো পদদলিত করে ভাঙা মন নিয়ে ফিরে যেতে হয় গ্রামে। অনেকসময় এমনও হয় যে, জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের অনন্য মেধা কাজে লাগানোর কথা ছিলো দেশ ও জাতীর সৃষ্টিশীল উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য। কিন্ত সুযোগ, সঠিক পরিচর্যার অভাবে একদিকে যেমন তাদের স্বপ্নগুলো ভেঙে টুকরোটুকরো হয়ে যায় তেমনিভাবে পরবর্তীতে সেই অসামান্য মেধা কাজে লাগে দেশ ও জাতীর ধ্বংসের কাজে। অথবা তাদের মেধা মূল্যহীন আবর্জনা মতো ভেসে যায় বুড়িগঙ্গার ছোট্টছোট্ট সফেদ ঢেউের মৌনতার বুকে।

শিশির হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রহলগুলোতে একটা সিট পেতে কত কষ্ট করতে হয়। এখানথেকে ওখানে ওখানথেকে সেখানে এই করতে করতে হলে থাকার শখ মিটে যায়। বিশেষ করে ক্যাম্পাসস্থ ছাত্রনেতাদের কাছে গিয়ে ধরণা দিতে হয়। কিন্তু শিশির তা করেনি। সোজাসুজিভাবে স্যারদের বলে দিয়েছে সিট দেওয়ার দায়িত্ব স্যারদের আর তা পাওয়ার অধিকার ছাত্র হিসেবে তার আছে। সিটের জন্য একাধীকবার স্যারদের নিকট আসতে তার কোন আপত্তি নেই কিন্তু কোন নেতাদের কাছে ধরণা ধরতে সে রাজি নয়। শিশির এবার ভর্তি পরিক্ষায় পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম হয়েছে তাই সে সিট পায়নি এমন সংবাদ স্যারদের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। তাই উপায়ন্তর না পেয়ে সংরক্ষিত আসনথেকেই একটা সিটের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় তাকে।

কারণ সিট পেতেও এখানে প্রচুর লবিং। এই সুযোগে নেতারা শিক্ষার্থীদেরকে নিজেদের অপরাজনীতির পতাকাতলে আসতে বাধ্য করে। তারপর ইচ্ছামত তাদের দিয়ে মিছিল- মিটিং সহ দলীয় জনসভায় উপস্থিত থাকতে বাধ্য করে। নিরুপায় হয়ে তাদের হুমকি- ধামকি, অস্ত্রের মুখে এগুলো করতে বাধ্য হয় সহজ- সরল মেধাবী ছাত্র- ছাত্রীরা। তারপর অনেকসময় এমন হয় যে নিয়মিত কুসঙ্গ পেতে পেতে একসময় কালেরগর্ভে বিলীন হয়ে যায় তাদের স্বপ্নিল চিন্তা চেতনা, নীতি- নৈতিকতা। তারপর অনেকে স্থায়ীভাবে হয়ে যায় কুচক্রোরই এজেন্ট। কোমল মেধাবী ছাত্র থেকে হয়ে যায় মায়াদয়াহীন ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী। কোন মেধা কোথায় কাজে লাগে ভাবা যায়! ভাবলেই এক বেদনাদায়ক, অস্বস্তিকর অনুভূতি হয়; চোখ ভরে ওঠে জলে।

প্রথমদিনে এমন অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতা অর্জন আর তার সাথে ভর্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পর মেধা তালিকার শীর্ষে অবস্থানকৃত কয়েকজন ছাত্রদেরও অনুরূপ কারণে হলে সিট না পেয়ে ভগ্ন হৃদয়ে বাসায় ফিয়ে যাওয়া ওর মনে দাঁগ কেটেছে। একটি অদৃশ্য ক্ষত সৃষ্টি করেছে হৃদয়ের অভ্যন্তরে। সারাক্ষণ দু’চোখে ভাসে সেই দৃশ্য। আরও ভেসে ওঠে এতোদিন যে সমস্ত শিক্ষার্থী এভাবে নীরব কান্না নিয়ে অসহায়ের মতো এই শিক্ষাঙ্গন ছেড়ে গেছে তাদের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়ার করুণ দৃশ্য। ও যেন দেখতে পেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা পার হয়ে যাওয়ার পর সেসমস্ত মেধাবীদের মনে আছড়ে পড়া ঊর্মিমালার তীব্র ঢেউয়ের কান্নাভেজা ক্ষীণ গর্জন। ওর দু গণ্ড বেয়ে নেমে এলো প্রতিবাদী অশ্রুর দুটি ধারা। তাতে চাঁদের আলো পড়ায় চিকচিক করছে; তা থেকে ঠিকরে পড়ছে যেন প্রতিবাদী, সংগ্রামী চেতনাত্মিকা।

কতক্ষণ নিবিষ্ট মনে ভাবলো শিশির। তারপর মাথা তুললো। মাথা তোলার সাথে সাথে দেখা গেল যেন আমাবস্যার সমস্ত আঁধার যেন ওর চাঁদ মুখে ভর করেছে। হঠাৎ করেই কি যেন ভাবলো; ভাবার পর মুখ কিছুটা শক্ত হয়ে উঠেছে তাতে ছড়িয়ে পড়েছে স্নিগ্ধ উজ্জ্বলতা।
শিশির মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা আর মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে দু’হাত তুলে প্রার্থনা করে বলেছিল, ‘হে প্রভু, আমাকে সাহায্য করুণ। প্রতিজ্ঞা করছি এই শিক্ষাঙ্গনকে আবর্জনা মুক্ত করতে আমার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ । আমাকে সাহায্য করুণ আর রহম করুণ আমার সকল শান্তি প্রিয় ভাইবোনেদের প্রতি। আপনার রহমত ছাড়া তো কোন কিছুই সম্ভব নয়। এ পথের সকল বাঁধা আপনি নিজ অনুগ্রহে আমার জন্য সহজ করে দিন। আমার সকল শান্তিকামী ভাইবোনেদের মুক্তি দিন এই অভিশাপ থেকে।’

প্রভাত হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। শিশির ফজরের নামাজ আদায় করে হলের সামনে চত্বরটাতে নিরিবিলি হাটছে। মনে মনে গুনগুন করে তেলাওয়াত করছে আল- কোরআনের মুখস্থ কিছু আয়াত। সকালের শান্ত- স্বচ্ছ নীল আকাশের দিকে নিবদ্ধ তার চোখ দুটি। দৃষ্টি যেন নিয়ন্ত্রণহীনভাবে আকাশের সীমা অতিক্রম করে লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে পৌঁছে গেল। এক অজানা অচেনা মহাশূন্য। চারিদিকে যেখানে তাকায় আদিগন্তজুড়ে শুধুই শূন্যতা। একফোঁটা প্রাণের অস্তিত্ব সেখানে নেই। নিভৃত- নিস্তব্ধে আবৃত এক অচেনা পরিবেশ। এ কোথায় এসে হারাল সে? চোখ মেলে তাকাল শিশির। মুহূর্তকালের মধ্যেই ফিরে এলো চির চেনা নীহারিকার বুকে। তার হৃদপিণ্ড থরথর করে কাঁপছে। খুব কাছ থেকে অতি একান্তভাবে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালার উপস্থিতি অনুভূত হলো তার অন্তরে। হৃদয় জুড়ে বয়েগলো পবিত্র একস্রোত। যেমনটা হয় নিবিষ্টমনে নামাজে দাঁড়ালে। সে ভাবতে লাগলো, স্রষ্টাকে অনুভব করার জন্য তো তাঁর অগণনীয় সৃষ্টির মাঝে নিজেকে সপে দেওয়াই যথেষ্ট। এরপরও মানুষ স্রষ্টাকে অস্বীকার করে কিভাবে? বিশেষ করে ধনীক সম্প্রদায় ও অতিউঁচ্চ পর্যায়ের মানুষ বেশিই স্রষ্টাকে এড়িয়ে চলতে চায়। কিন্তু কেন? এই যে বিশাল সৃষ্টিজগৎ, চারিদিকে যা কিছু দেখি তা কি আপনা আপনি সৃষ্টি হতে পারে? – না পারেনা। এর পিছনে অবশ্যই একজন সর্বজ্ঞ স্রষ্টার উপস্থিতি থাকতে হবে; নয়ত এই পৃথিবীর নিয়ম শৃঙ্খলা একমুহূর্তে ভেঙেপড়া অবশ্যম্ভাবী। তাহলে যারা ঢাকঢোল পিটিয়ে স্রষ্টা নেই স্রষ্টা নেই বলে প্রচার করে তারা এগুলো কেন করে?

-সরল হিসেব অনুযায়ী মাত্র দুটি কারণ থাকাটাই স্বাভাবিক।

এক, তারা কখনো স্রষ্টার অস্তিত্ব খুঁজতে চেষ্টা করেনি।
দুই, তারা সাধারণ বিশ্বাসী সম্প্রদায় থেকে স্রষ্টা সম্পর্কে অধীক পরিমাণে বেশি জ্ঞাত। আর তারা এটিও জ্ঞাত হয়েছে যে, যদি তারা স্রষ্টার উপস্থিতি মেনে নেই তবে তাদের স্বার্থে আঘাত লাগবে। যদি স্রষ্টা আছে এই তত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তবে তাদের প্রবর্তিতমতবাদ বিলুপ্ত হবে। তখন তারা স্বাধীনভাবে কোনকিছু করার অধিকার রাখবেনা। তখন মানুষের চোখ খুলে যাবে। একটা অদৃশ্য নিয়মের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়বে তারা। তাদের আগাগোড়া থরেথরে মিথ্যায় গাঁথা রাজ্য ভেঙে খান খান হয়ে যাবে।
তাদের পাপাচারের উপর প্রতিষ্ঠিত সকল বিজনেস বন্ধ হয়ে যাবে।

শিশিরের চোখ- মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মনে মনে দৃঢ় সঙ্কল্প করল যে, যেভাবেই হোক এই অবস্থা থেকে আপামর জনসাধারণকে ফিরিয়ে আনতেই হবে; রক্ষা করতে হবে প্রিয় শিক্ষাঙ্গনকে ।
কিন্তু তা কি সম্ভব? মুখে বলা আর কাজে পরিণত করা তো এক নয়।
শিশিরের মুখ কিছুটা শক্ত আর দৃঢ় হয়ে উঠল। হ্যাঁ ইনশাআল্লাহ সম্ভব। আল্লাহ্ তায়ালা তো বলেছেন হেদায়াত দেওয়ার মালিক তিনি আমাদের দায়িত্ব সত্যের দাওয়াত যুক্তি দিয়ে আধুনিক যুগে আরও অত্যাধুনিক উপায়ে তাদের তাদের কাছে উপস্থাপন করা।
আমাদের মত তরুণরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এলেই কেবল তা সম্ভব। তাদের একসূঁতায় বাঁধতে পারলে সম্ভব একটি সুন্দর সমাজ গড়ে তোলা। তাছাড়া সত্যান্বেষীদের দ্বারাই কেবল প্রতিরোধ করা যাবে সেসব কুচক্রীদের। ভেঙ্গে দেওয়া যাবে তাদের লিপ্সা মিশ্রিত কু- আশা।

কয়েকমাস পরের কথা। এরমাঝে ক্যাম্পাসে শিশিরের অনেকগুলো ভক্ত- শুভাকাঙ্খি জোগাড় হয়েছে। তাদের মধ্যে আছে সিনিয়র ভাইয়েরা এবং বেশ কয়েকজন সম্মানিত অধ্যাপকও। সল্পভাষি লাজুক ছেলে শিশিরের সুন্দর- মার্জিত ব্যবহার, অনুপম ব্যক্তিত্ব, অনুকরণীয় চরিত্র, আর মানুষকে কাছে টানার অনন্য বৈশিষ্ট্য তাকে খুব সহজেই তাদের মনে সম্মান-ভালোবাসার আর স্নেহপাত্র হয়ে মনেরগহিনে জায়গা করে দিয়েছে। আর তার চোখ মুখের পবিত্র লাবণ্য তাকে সবার কাছে বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে। একপলক চেয়ে থাকলেই মনে হয় যুগযুগান্তরের পরিচিত, অতি প্রিয়জন। তার কণ্ঠনিঃসৃত কথাগুলো এতোটাই মুগ্ধকর যে অল্প কয়েকটি কথা শুনলেই মন ভরে যায়। মনে হয় সে একান্ত আপনজন।

মানুষের সবচেয়ে ভাল গুণ হলো বিনয়ী হওয়া। শিশির এতটাই বিনয়ী যে নিজের কৃতিত্বও নিজের বলে নিজ মুখে স্বীকার করেনা। শিশিরের পরিচিত অনেকেই আগে মাঝেমধ্যে জুম্মার নামাজ ছাড়া মসজিদমুখী হত না কিন্তু তার অক্লান্ত চেষ্টা আর ইসলাম সম্পর্কে খুব অল্প কথায় বাস্তবমুখী বেসিক ধারণা তাদের নিয়মিত মসজিদে আসতে প্রায় বাধ্য করেছে। এছাড়াও তাকে বেশি আলোচিত করেছে সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় অডিটোরিয়ামে রাখা এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্য।

বক্তব্যের মূল টপিক ছিল ‘শ্রেণী বৈষম্য থেকে উত্তরণের উপায়’ সমন্ধে। সবরকম মৌলিক সমস্যা থেকে সফলভাবে বেরিয়ে আসার নিঁখুত এবং শ্রেষ্ঠ উপায়ের উপমা দিতে গিয়েই সামনে এসে যায় ইসলামিক জীবনদর্শনের বর্ণনা। ইসলামকে শুধুমাত্র ‘শান্তি’ নামক শব্দ দ্বারা কেমনভাবে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে এবং এর পূর্ণাঙ্গ অর্থ কেমনকরে সুপরিকল্পিত উপায়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে তাও চলে আসে বক্তব্যের মধ্যে। সবচাইতে তোলপাড় করে শেষোক্ত কথাটি।

যার সারসংক্ষেপ ছিল এমন, “ইসলাম কি শুধুমাত্র ধর্ম? আমরা ইসলামকে যখন ধর্ম বলে আখ্যায়িত করি তখন আমাদের চোখে ভেসে ওঠে নামাজ, রোজা, হজ্বব্রত পালনের দৃশ্য। ভেসে ওঠে মসজিদের কোণে বসে নফল ইবাদত আর তসবিহ জপার দৃশ্য। কিন্তু ইসলাম মানে কি শুধুই এগুলো? না। ইসলামকে অন্যান্য ধর্মের সাথে গুলিয়ে ফেলার কোন সুযোগ নেই। ইসলামের যেমন আছে ধর্মীয় অনুশাসন (ব্যক্তিজীবনে) তেমনিভাবে আছে পৃথক সংস্কৃতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, আছে জীবন পরিচালনার এসবনীতি সংবলিত আসমানি কিতাব মহাগ্রন্থ আল-কোরআন যা সমগ্র মানবজাতির জন্য সংবিধান। এককথায় ইসলাম অন্যান্য ধর্মের মতো শুধু সংস্কৃতিচর্চার ধর্ম নয়; ইসলাম সমগ্র মানবজাতির জন্য একমাত্র উন্নত জীবনবিধান। একমাত্র পরিপূর্ণভাবে ইসলাম অনুসরণের মধ্য দিয়েই উত্তম চলতে পারে ব্যক্তিগত-পারিবারিক-রাষ্ট্রিয়- এবং বৈশ্বিক জীবন।”

এমন ছোট্ট সুন্দর বিশ্লেষণ মূলক বক্তব্য উপস্থাপন করে শিশির। এরপর থেকে তাকে ক্যাম্পাসে রীতিমত ছোটখাটো ইসলামিক বিশেষজ্ঞের ভূমিকা পালন করতে হচ্ছে। প্রতিদিন অনেক শিক্ষার্থীর প্রশ্নোত্তর করতে হয় তাকে। কিন্তু এতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধকরে সে। ইসলামিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান স্যার তাকে ভীষণ স্নেহ করেন।

শিশিরের নির্দেশনামূলক বক্তব্য এবং সুন্দর উদ্যোগ একদিকে যেমন অধ্যাপক এবং অধিকাংশ সচেতন শিক্ষার্থীর নিকট তাকে প্রশংসিত করেছে তেমনিভাবে তার এই সুচিন্তিত বক্তব্য আলোড়ন সৃষ্টি করেছে সবার অলক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রহসনের রাজত্ব যারা পরিচালনা করছেন তাদের মধ্যে। তাদের শরীরে রীতিমত আগুন ধরিয়ে দেবার মতো ব্যাপার ঘটেছে। তারা ভীষণ ক্ষুব্ধ শিশিরের প্রতি।

কিন্তু তারা সামনাসামনি কিছু বলার সাহস রাখে না শিশিরের জনপ্রিয়তায়। তাছাড়া ওর সামনে উপস্থিত হতেও ওরা ভয় পায়। এ ভয় হলো কনভেন্স হয়ে যাওয়ার ভয়। ওরা মনে করে অদ্ভুত একটা শক্তি আছে তাঁর। যেই ওঁকে ঘাঁটাতে যায় বন্ধু আর ভক্ত হয়ে ফিরে আসে। তাদের চোখের সামনেই অনেকেকে এমনটা হতে দেখেছে অপরাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। অনন্যোপায় হয়ে অদৃশ্যভাবে তাকে ঈর্ষাকরতে থাকে তারা।

আল্লাহর অসীম রহমতে সুপরিকল্পিতভাবেই সৃষ্টি করা হয়েছে একটি আদর্শবাদী ছাত্র সংগঠন। যে সংগঠনের মূলনীতি হলো স্বয়ং আল- কোরআন এবং যাদের আদর্শ হলো মানবতার মুক্তির পথিকৃৎ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব রাসূল (সা.) । যাদেরকে এ দলের পরিচালনা পরিষদে নেওয়া হয়েছে তারা সকলেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রত্ন, একেকটা উজ্জ্বল নক্ষত্র।
সকলকে বাছাই করেছে শিশির। এতদিন ধরে সবাইকে ইসলামিক বিষয়ে প্রয়োজনীয় মৌলিক জ্ঞান শিক্ষাও দিয়েছে শিশির।
রসূল (সা.) এর নির্দেশিকা অনুযায়ী একটি ইসলামী সংগঠনের নেতৃত্বেরগুনাবলীও পূর্ণভাবে ফুটিয়ে তুলেছে তাদের মধ্যে। সবাই এখন ক্যাম্পাসের সকল মানুষের কাছে আস্থা, ভালোবাসা আর সম্মানের পাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ঙ্গনের যে কেউ যেকোনো সমস্যায় পাশে পাবে এই দলটির সেচ্ছাসেবীদের। সবাই যেন নির্দ্বিধায় তাদের সমস্যাদি জানাতে পারে এবং তড়িৎ প্রতিকার পেতে পারে তার জন্য দলে রাখা হয়েছে সবার আস্থাভাজন ব্যক্তিদেরই। সবকিছুই পরিকল্পনা অনুসারে নিঁখুতভাবে সম্পন্ন হয়েছে। পরিকল্পনাকারী হলেন শিশির খাঁন। সর্বসম্মতিক্রমে সেই এ নব্যদলটির প্রতিষ্ঠাতার পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পেয়েছে; যদিও সে চাচ্ছিল এ দায়িত্ব অন্যকেউ গ্রহণ করুক। সে সাধারণ কর্মী হয়েই তাদের সর্বাত্মক সাহায্য করবে। কিন্তু উপদেষ্টাগণ তা মেনে নেননি। তারা বলেছেন ইসলামি দলের প্রত্যেকটা নেতৃবৃন্দ হলো একেকজন কর্মী। তারা দায়িত্ব যেমনি নিজে থেকে চেয়ে নিতে পারেনা তেমনি দায়িত্ব পেলে সঙ্গত কারণ ছাড়া নিজ ইচ্ছায় অব্যাহতিও পেতে পারেনা।

এই দলটির রূপকল্পনাকারী শিশির হলেও এমন একটি দল গঠন করার অনুপ্রেরণা পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোঃ আলফাজ উদ্দিন স্যার, ইসলামিক বিভাগের প্রধান ড. মাহফুজ আহমেদ স্যার এবং ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান কে এম
আঃ রহমান স্যারের কাছথেকে। প্রবীণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রভাবশালী অধ্যাপক আলফাজ উদ্দিন স্যার শিশিরের কাঁধে হাত রেখে গর্বোজ্জ্বল মুখে বলেছিলেন, ‘তুমি একটি অবিশ্বাস্য কাজ করেছ বৎস। ক্যাম্পাসের তিন চতুর্থাংশ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে তোমাকে এবং তোমার সুন্দর প্রচেষ্টাকে পছন্দ করেন, সমর্থন করেন। এখন তাদেরকে এভাবেই একই প্লাটফর্মে রাখার একটিই মাত্র উপায় আছে। আর তা হলো একটি আদর্শ সেচ্ছাসেবী দলগঠন করা এবং সবাইকে সেই দলের ছত্রছায়ায় নিয়ে আসা। বিশ্বাস এবং ভালোবাসা তো তুমি আগেই অর্জন করেছ কিন্তু দলগঠনের পরে প্রয়োজন হবে সবার আস্থাঅর্জন করে টিকে থাকার লড়াইয়ে মেধা, যোগ্যতা, বিবেক- বুদ্ধি এবং ব্যতিক্রম চারিত্রিক মাধুর্জতা দিয়ে অনন্য নজির উপস্থাপন করা। এবং এরপর তোমাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন হতে হবে; হতে হবে দৃঢ় প্রত্যয়ী। হতে হবে সাহসী, নির্ভীক আর অত্যাচারী বাতিলের জন্য এক অদৃশ্য আতঙ্ক। কারণ, তখন তোমার অপজিটে থাকবে বিপরীত আদর্শবাদী দলগুলো। তাদের কাজ দুর্বলের উপর নিপীড়ন চালিয়ে তাদের কাঁধে ভর করে স্বার্থসাধন করা। কিন্তু তোমাদের দায়িত্ব হবে হবে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সংগ্রাম করা। ধর্ম- বর্ণ নির্বিশেষে এই ক্যাম্পাসের সকল দুর্দশাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো, সবার সবরকম বিপদআপদে তাদের সাহায্য করা। অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ বাঁধা সৃষ্টি করা। সুসময়ে তাদের গাইড করা। অপরাজনীতির ভয়াবহতা ব্যক্তি, পারিবারিক এবং জাতীয় জীবনের জন্য কতটা ভয়াবহ হুমকিস্বরূপ তা সবার সামনে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট করা। এসবের মধ্যদিয়ে তোমাদের লক্ষ হবে বর্তমান সমাজে ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ মুসলিম তরুণ- তরুণীদের মন- মননকে জাগরিত করা। ইসলামের স্বর্ণোজ্জ্বল অতীত তাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া। ইসলাম মানে মসজিদের কোণায় বসে তসবি জপা নয়; নিরুপম সংবেদনশীল অন্তর হওয়া সত্ত্বেও হাতে অস্ত্রনিয়ে অপশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে এক আল্লাহ ভীতি নিয়ে বিশ্বজোড়া ইসলামী সাম্রাজ্য গড়ার ইতিহাস ও তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। তাদের চোখ থেকে ভ্রান্তির পর্দা সরিয়ে হেরার দ্যুতি এঁকে দিতে হবে।
এর জন্য প্রয়োজন লিফলেট সহ ইসলামিক স্কলারদের সৃজিত নানারকম প্রকাশন তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। তার ব্যবস্থা আমরা করব। এগুলো যদি তোমরা নিঃস্বার্থভাবে করতে পার, তবে তোমরা একটি ইসলামি সমাজ গড়ার কাঙ্খিত লক্ষের পানে আরও একধাপ এগিয়ে যাবে।

আর অন্যান্য জাতির কাছে আস্থা, ভালোবাসা, আর সবরকম উত্তমগুনাবলি দিয়ে তাদেরকে তোমরা ডাকবে তোমাদের দলে। আহ্বান করবে সত্যেরপথে, মুক্তির একমাত্র পয়গাম সুমহান ইসলামের দিকে। কারণ সবকিছুর মধ্যে এটা মনে রাখতেই হবে মাস্ট যে, মুসলিম মানে মিশনারি জাতি। সত্যের আহ্বান সব ধর্মের মানুষের মাঝে পৌঁছে দেওয়ার জন্য স্রষ্টার প্রতিনিধি আমরা। যেখানে প্রত্যক্ষভাবে পৌঁছানো যায়না সেখানে দাওয়াত হবে তোমাদের চরিত্র, আচার- আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি- মূল্যবোধ, ন্যায়পরায়ণতা এবং পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসার অনুপম দৃষ্টান্ত উপস্থাপন। যাতে অন্যান্য ধর্ম এবং সকল মতবাদের তুলনায় মুসলিমদের সমস্ত রীতিনীতি- জীবনবিধান কতটা আধুনিক এবং মানসম্মত তা যেন তারা সহজেই উপলব্ধি করতে পারে। আর সর্বোপরি এ দলে যারা আসবে তাদের সবাইকে ইসলামিক জ্ঞানার্জনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাদেরকে গড়ে তুলতে হবে একাধারে একেকজন আদর্শ ধর্মপ্রচারক, রাষ্ট্রনায়ক, এবং সাহসী- নির্ভীক সিপাহসালার, এবং ন্যায়ের উপর অধিষ্টিত সুবিচারক রূপে। কারণ পরবর্তীতে তোমরাই হবে দেশের ভবিষ্যৎ পরিচালনাকারী। তখন এগুলোই প্রয়োজন হবে সফল একটি ইসলামিক রাষ্ট্র পরিচালনে। এজন্য পরবর্তীতে ইসলামের বেসিকজ্ঞান না থাকলে কেউ এই আদর্শদলের কর্মী পর্যায়ে উন্নীত হতে পারবেনা। তোমাদের সবকিছুই হবে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনার্থ্যে।এভাবেই আল্লাহ তায়ালার দেওয়া দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে থাকো। তাদের মধ্যে কে তোমাদের সাথে আসলো আর কে এলো না তা নিয়ে ভেব না। হেদায়েত দেওয়ার মালিক আল্লাহ্ নিজেই। আমাদের দায়িত্ব সর্বান্তকরণে যথাযথভাবে দাওয়াত পৌঁছানো।’

এভাবেই দূরদর্শন নিয়ে ৮ সদস্যবিশিষ্ট সেক্রেটারিয়েট নিয়ে যাত্রা করে নব্যপ্রতিষ্ঠিত দল “মুসলিম রেনেসাঁ” এবং আস্তে আস্তে রসূল (সা.) এর আদর্শ অনুযায়ী উপদেষ্টাজনদের দেখিয়ে দেওয়া পথে অগ্রসর হতে শুরুকরে।’

তারপর আস্তে আস্তে ছোটখাটো বিপদের বহু
চড়াই – উৎরায় অতিক্রম করে ”মুসলিম রেনেসাঁ” নামক দলটি বিরোধীদের সবার অগোচরেই বিস্তৃত হয়ে যায় ক্যাম্পাস জুড়ে। স্যারদের কথানুযায়ী প্রতিটা হলেই সেক্রেটারিয়েটগণ একজন করে ছড়িয়ে পড়বে এবং সেখানে তাদের শুভাকাঙ্খিদের মধ্যে কাজ করতে থাকবে। যেহেতু এখন দলটির জনবল খুব কম তাই অদৃশ্যভাবে কাজ করতে হবে। তারপর আল্লাহ তায়ালা রহমত করলে যখন “মুসলিম রেনেসাঁ’র দাওয়াত সবার নিকট পৌঁছাতে পারবে তখন প্রকাশ্যভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলবে মহতী এ দলটির তৎপরতা। আর আল্লাহ চাহেন তো একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছে যাবে দেশের প্রত্যন্তঅঞ্চলেও। আর এই সংগঠনকে আরও গতিশীল করার লক্ষে মেয়েদের মধ্যেও দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন স্যাররা। মেয়েদের হলের প্রধান হিসেবে কাজ করেছে ইংরেজি অধ্যাপক স্যারের মেয়ে মুহতারামা ফারহানা আফরোজ এবং তার সেক্রেটারি হিসেবে আছেন ভাইসচ্যান্সেলর স্যারের মেয়ে নুসাইবা তাসনিম। এবং তাদের সহযোগী আছেন হযরত মা আয়েশা (রা.), ফাতেমা (রা.) এর উত্তরসূরি কিছু আলোক পথের অভিযাত্রী বোনেরা।
এই দলগঠনে ভাইসচ্যান্সেলর স্যার প্রত্যক্ষ কিছু না বললেও মৌন সম্মতি ছিল তাঁর। তিনিই বলেছিলেন তার কন্যাকেও এদলে সামিল করে নিতে।

এভাবেই সবার অদৃষ্টে তারা কাজ করতে থাকে । শিশির খাঁন এবং তার সহযোগী সেক্রেটারিয়েটদের আন্তরিক দায়িত্বশীলতা, দুর্বার প্রচেষ্টা, এবং অক্লান্ত পরিশ্রমে অল্প সময়েই অনেকটা পথ এগিয়ে দেই তাদের অগ্রযাত্রাকে। নৈতিকতা এবং ভালোবাসার সংমিশ্রণে গড়া এক অনন্য বৈশিষ্ট্য খুব সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে তরুণ শিক্ষার্থীদের। বিশেষ করে ক্যাম্পাসের মধ্যে বিপদআপদে নিপতিত যেকোনো ছাত্রছাত্রীর ডাকে “মুসলিম রেনেসাঁর কর্মীরা সম্মিলিতভাবে আন্তরিকতার যে অনুপম দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে চলছে তার চাইতে দ্রুতগতিতে বেড়ে চলছে তাদের সংগঠনের বিস্তৃতি। অন্যদিকে সমান গতিতে নিষ্ক্রিয় হচ্ছে নষ্ট রাজনীতির ভয়ঙ্কর তৎপরতা। ইদানীং ক্যাম্পাস জুড়ে যে অনাকাঙ্খিত পরিবর্তন এসেছে তা তারা ‘নষ্ট রাজনৈতিক নেতা’ অনুধাবন করতে পারছে। আজকাল কেউ তাদের সমীহ করেনা বলে মনে হচ্ছে। অনেক আভ্যন্তরীণ নেতাকর্মীরাও এড়িয়ে চলছে তাদের। আজকাল ক্যাম্পাস জুড়ে যে তথাকথিত আরব্য সংস্কৃতির প্রভাব বা একটা আনস্ট্যান্ডার্ড (তাদের দৃষ্টিতে) হুজুর হুজুরভাব এসেছে তাও তাদের দৃষ্টি এড়াচ্ছে না। ইদানীং দেখছে ছেলে মেয়েদের অবাধ মেলামেশা শুধু কমেইনি বরঞ্চ ছেলেরা সামনে পড়লে মেয়েরা আর মেয়ে সামনে আসলে ছেলেরা উভয়ই তাদের দৃষ্টি নিম্নগামী করে নিচ্ছে। এক স্বপ্নিল, মিরাকল ব্যাপার ঘটছে এই দেশসেরা শিক্ষাঙ্গনে। কিন্তু এসবের পিছনে সুপ্ত কারণটা বুঝতে পারছে না দৃষ্টিভ্রমের অত্যন্ত গভীরে আটকে পড়া অপরাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ।

অবশেষে এলো সেই প্রতিক্ষিত ক্ষণ। সহস্র মানুষের প্রাণের এই ছোট্ট সংগঠনকে প্রত্যক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়ার সময়। খুব বড়সড় আর জাঁকজমকপূর্ণভাবে ভি, আই, পি লাউঞ্জে আয়োজিত হয় সে অনুষ্ঠান। সেখানে দাওয়াত প্রাপ্ত হন স্বয়ং ভিসি স্যার সহ সকল অধ্যাপকগণ। সেদিন বিরুদ্ধবাদীরা শুধুই দেখল একটা মিরাকল সৃষ্টি। একটি মাত্র ডাকে বেরিয়ে এসেছে ক্যাম্পাসের হাজার- হাজার ছাত্রছাত্রী।

তাদের লিফলেট, ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমগ্র ক্যাম্পাস। একঅনন্য আনন্দঘন পরিবেশ। সবার কণ্ঠ থেকে স্লোগান নিঃসৃত হচ্ছে..

‘মুসলিম রেনেসাঁ জিন্দাবাদ। শিশির খাঁন জিন্দাবাদ। / ক্যাম্পাসের দখলদাররা হুশিয়ার সাবধান। / ইসলাম মানে শান্তি, ইসলাম মানে শৃঙ্খলা, ইসলাম মানে সমৃদ্ধি। এসো সবাই দলে দলে ইসলামের আলোর পতাকা তলে। শ্রেণী- বর্ণ নির্বিশেষে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম চলবে দুর্বার গতিতে।’

এই জনসমাগমে ছাত্রনেতারা বিরুদ্ধাচরণ করা তো অনেক দূরের কথা। এরভয়ে তারা রাজনৈতিকতার খোলশছাড়া হয়ে সাধারণের ভিড়ে মিশেগেলো অল্প সময়ের মধ্যেই।

৩.

সমাবর্তন অনুষ্ঠানের শেষার্ধ। অনুষ্ঠান চলছে আপন গতিতে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সম্মানিত রাষ্ট্রপতি বসে আছেন মঞ্চের একদম কেন্দ্রবিন্দুতে। উনার সামনে রাখা আছে ঈষৎ সাদা রঙের উপর ছাই মিশ্রিত রঙের একটা ফাইল। যার উপরে জ্বলজ্বল করছে ‘শিশির খাঁন’ নামটি। প্রেসিডেন্ট সাহেব নিবিষ্টচিত্তে পড়ছেন বিবরণ। উনার পাশের উৎসুক, উৎকণ্ঠি অতিথিগণ খেয়াল করছেন, পড়ার সময় মাঝেমাঝে উনার মুখ হয়ে উঠছে শক্ত, কঠোর আবার কিছুক্ষণের মধ্যেই তা হয়ে উঠছে উজ্জ্বল, কোমল, প্রাণবন্ত। পড়া শেষ হতেই তার স্বগত কণ্ঠ থেকে প্রস্ফুটিত হলো, ‘সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ তায়ালার জন্য।’
কিছুটা উচ্ছ্বাস ঝরে পড়লো যেন উনার কণ্ঠ থেকে। সবাই খেয়াল করলো সেটা। পড়া শেষ করেই উনি তাকালেন ভিসি সাহেবের দিকে। তারপর বললেন, ‘মিঃ প্রফেসর, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। সেটা মিডিয়ার সামনে ব্রিফ করার আগে আপনার এবং কয়েকজন সিনিয়র অধ্যাপকের সাথে এবিষয়ে একটু ডিসকাস করতে চাই। আপনি ব্যবস্থা করুণ।’

‘জ্বী, স্যার।’ – ভিসি সাহেব উত্তর দিলেন।
‘আর হ্যাঁ, সেখানে কিন্তু অবশ্যই আজকের আলোচনার মধ্যমণি শিশির খাঁনকে থাকতে হবে।’ প্রেসিডেন্ট সাহেব স্বাভাবিক কণ্ঠ কথাগুলো বললেও শ্বাসরুদ্ধকর একটা উৎকট ভীতিকর অনুভূতি সৃষ্টি হলো ভিসি সাহেবের মনে। উনিও মুখে কৃত্রিম একখণ্ড হাসি ফুটিয়ে আনুগত্য স্বরে ‘হ্যাঁ’ বোধক জবাব দিয়ে উঠে এলেন মঞ্চ থেকে।

অতি লাবণ্যময়, পবিত্র… সহজ- সরল ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আছেন প্রেসিডেন্ট সাহেব। সবার অগোচরে মনে মনে তাকে একবার আপাদমস্তক স্কান করে নিয়েছেন তিনি। খুব চেনা পরিচিত একটা চেহারা মেলাতে চেষ্টা করছেন তিনি। হলরুমে ডিসকাশনে অংশনেওয়া সকল অধ্যাপকবৃন্দ পিনপতন নীরবতা সৃষ্টিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। সবাই যেন শব্দ করা ভুলে গিয়েছেন।

কয়েকমিনিট পরে হঠাৎ উনি কথা বলে উঠলেন শিশিরকে লক্ষ করে, ‘শিশির খাঁন, তুমি সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আশরাফ খাঁন তারিককে চেন?’ হাল্কা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল তার কণ্ঠে। হলরুমের সবাই হচকিয়ে উঠলো।
হঠাৎ একথা কেন উঠলো? জনাব আশরাফ খাঁন তারিক ছিলেন বাংলাদেশের একজন সফল সেনানায়ক। তিনিই আধুনিক সেনাবাহিনী গঠন করে অল্প কয়েকবছরে বিশ্বসামরিক র‍্যাঙ্কিংএ বাংলাদেশকে সম্মানজনক পর্যায়ে উপনীত করেছিলেন। সৎ এবং সজ্জন সেনাধ্যাক্ষ হিসেবে তিনি খ্যাত হয়ে আছেন এই বঙ্গ জনপদে। হঠাৎ তার কথা উঠতেই সবাই বিস্মৃত হলেন। শিশিরের সাথে উনার কি পরিচয় থাকতে পারে? কেউ কথা বলতে পারছেনা কিন্তু কৌতূহলী প্রশ্ন সবার চোখ মুখে; তাদেরকে আচ্ছন্ন করে আছে বিস্ময়।
শিশির তার নিম্নগামী দৃষ্টি ঈষৎ উঁচু করে প্রেসিডেন্ট সাহেবের চোখের দিকে তাকাল; তারপর চোখ নামিয়ে নরম- শান্ত, তবু স্পষ্ট কণ্ঠে জবাব দিল, ‘জি স্যার, উনি আমার পিতা।’

স্যাররা যেন নতুন এক শিশিরকে আবিষ্কার করছেন। জগতের সব বিস্ময় যেন তাদের ঘিরে ধরেছে। আনন্দে চিকচিক করছে প্রেসিডেন্ট সাহেবের চোখ। উনি মুখে একখণ্ড হাসি এঁকে আনন্দিত কণ্ঠে বললেন,’তাহলে আমার ধারণা সঠিক! আমি প্রথম চাহনিতেই তোমার চোখে দেখেছি আমার দেখা সবচাইতে সৎ, সাহসী, নির্ভীক, কোমল হৃদয়ের, অসাধারণগুনে গুণান্বিত মানুষটির দৃষ্টি, সেইম মুখাবয়ব। স্যার যখন সেনাপ্রধান ছিলেন আমি তখন ছিলাম সুপ্রিমকোর্টের তরুণ বিচারপতিদের একজন। কাছ থেকে উনাকে খুবই কম দেখেছি; কিন্তু অল্প দেখাতেই অপরিমিত ভালোবাসা, অঢেল স্নেহ পেয়েছি। তাই হয়ত যতটুকু দেখেছিলাম ততটুকুতেই ছোট লিস্টের আপনজনের মধ্যে উনার নামটিও মনের ডায়েরীতে অজান্তেই লেখা হয়ে গিয়েছিল। উনি আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন আর মুখে মমতাপূর্ণ হাতরেখে বলতেন আমি নাকি আরও অনেক বড় হতে পারব! স্যার রিটায়ার হওয়ার পর বিদেশ চলে গেলেন তারপর বহুবছর যাবৎ আর যোগাযোগ হয়নি। সামনে থেকে একটুকরো টিস্যু নিয়ে চোখ মুছলেন তিনি। সবার চোখ ছলছলে হয়ে এল এমন শক্ত সমর্থ মানুষটির সংবেদশীলতায়।

‘দুঃখিত, ‘প্রেসিডেন্ট সাহেব বললেন, ‘অনেকদিনের জমানো আবেগ তাই এমন অনাকাঙ্খিত স্ফুরণ ঘটলো, এগেইন সরি মিঃ প্রফেসরস।’

সবাই মুখে চোখের ভাষায় ফুটিয়ে তুললেন আনুগত্যের চিহ্ন।
প্রেসিডেন্ট এবার তাকালেন শিশিরের দিকে। সবাই তাঁকে অনুসরণ করলেন। শিশির লাজুকলতায় দৃষ্টিনিম্ন করে রেখেছে। এতে তার মুখে ফুঁটে উঠলো সারল্যেভরা পবিত্রতা। উঠে দাঁড়ালেন প্রেসিডেন্ট সাহেব সাথে সাথে উপস্থিত সবাই। প্রেসিডেন্ট সাহেব সবাইকে বসতে অনুরোধ করে শিশিরকে কাছে টেনে নিলেন তারপর বলতে আরম্ভ করলেন, ‘শিশির খাঁন। ফাইলে তোমার এবং তোমাদের সৃজিত “মুসলিম রেনেসাঁ” সম্পর্কে পড়ে খুব আনন্দ পেয়েছি। তরুণ- নব্যযুবসম্প্রদায়ের এমন মহতী চিন্তাধারা, উদ্যম কর্মকুশলতা আমাকে মুগ্ধও করেছে। কিন্তু তোমাকে চেনা এবং জানার পর সেই মুগ্ধতার সাথে যোগ হয়েছে আশাব্যঞ্জক প্রত্যাশা। আমি সমগ্র বাংলার পক্ষ থেকে, সমগ্র মুসলিম জাতীর পক্ষ থেকে তোমাদের সকলকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।

বিশেষকরে বর্তমান সমাজে এত হিংসা,বিদ্বেষ, মারামারি- হানাহানী, জুলুম- নির্যাতন, সুদ- ঘুষ, ক্ষমতার অপপ্রয়োগ, সহ এককথায় সকল সেক্টরে দুর্নীতি যেভাবে অণু- পরমানুতে ছড়িয়ে পড়ে দুর্ভেদ্য এক প্রাচীরের মতো আত্মপ্রকাশ করেছে তার মূলে আছে নৈতিক অবক্ষয় এবং তাকওয়া বা আল্লাহভীতি ভুলে যাওয়া। আর জাতীর এই অমূল্য সম্পদ ‘নৈতিকতা’ বিলুপ্তি হয়েছে আমাদের সুশিক্ষার অনুপস্থিতি আর ধর্মীয় সংস্কৃতি থেকে বহু দূরে অবস্থান করার কারণেই। তাই এগুলো যদি কোন জাতী ফিরে পায় অথবা অর্জন করতে পারে তবে তাদের কোন প্রচেষ্টাকে রোধ করার সাধ্য কারও নেই। তাই শিক্ষিত জাতীকে ধর্মীয়জ্ঞানের সাথে মানবিক মূল্যবোধ শেখানোর মাধ্যমে শিক্ষিত থেকে সুশিক্ষিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া এবং অন্ধের চোখে আলো দেখানোর মতো সহস্র মানুষকে স্রষ্টামুখী করার যে মহৎ পরিকল্পনা তোমরা নিয়েছ এবং অল্প সময়েই আল্লাহর রহমতে সফলতার যে নজীর উপস্থাপন করেছ তা শুধু তোমাদের নয় সমগ্র জাতি, সমগ্র মুসলিমদের স্বার্থকতা। এজন্য তোমার সমস্ত সহযোদ্ধা শিক্ষার্থীদেরকে এই মহৎ প্রচেষ্টার জন্য সম্মান, স্নেহ, এবং শুভকামনা জানাচ্ছি।

আমি ভিসি সাহেবের নিকট থেকে জেনে নিয়েছি ভার্সিটির মৌলিক কিছু পরিবর্তনের কথা। প্রতি ওয়াক্ত নামাজে ক্যাম্পাসস্থ সকল মসজিদগুলো ভরে যায়। ছাত্রছাত্রীদের চোখে এখন নমনীয়তা, সম্মান দেখতে পারা যায় যা ইতোপূর্বে অধ্যাপকবৃন্দ অবলোকন করেননি। আর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মানুষে মানুষে যে সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়েছে তা যেন আমি নিজেও হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারছি। হ্যাঁ বৎস সত্যিকারের ইসলাম এমনই হয়। এর স্পর্শে যারা একবার আসে তারা তারা তেমনই বদলে যায় যেমনটা বদলায় পরশপাথরের ছোঁয়ায়। ইসলাম একটি জীবন্ত পরশপাথর। ইসলাম এমন একটি আবরণ দ্বারা নিজেকে আবৃত করলে উঁচু- নিচু, ধনী- গরীবের শ্রেণী- বৈষম্য থাকেনা এই পরিবেশে সবার অবস্থান সমান। বরঞ্চ এই সমাজে জ্ঞানের অনুশীলন এবং তার পরিপূর্ণ চর্চার মানদণ্ডে বিচার করা হয় কে কোন স্তরের সম্মানীয়। আর এই সমতার থিউরি যদি কোন জাতি অনুশীলন করে তবে তাদের মধ্য থেকে সর্বপ্রথম বিলুপ্ত হয় হিংসা- বিদ্বেষ, দূরীভূত হয় অহংকার আর সেই শূন্য স্থান পূর্ণ হয় সুখ, শান্তি, ভালোবাসায় আর সৃষ্টি হয় যাবতীয় স্বর্গীয় পরিবেশ।

বেশকিছু সময় ধরে সবাই চুপচাপ। নীরব অশ্রুর দুটি ধারা গড়িয়ে পড়ল শিশিরের গাল বেয়ে। নজর এড়ালোনা প্রেসিডেন্ট সাহেবের। তিনি জড়িয়ে ধরলেন শিশিরকে। শিশির একটু শব্দ করে কেঁদে উঠলো। সাথে সাথে রুমভর্তী অধ্যাপকগণের এতক্ষণ আটকে রাখা জলকণাগুলো চঞ্চল গতিতে নেমে এলো। প্রেসিডেন্ট সাহেব স্বর্ণজ্জ্বল চোখে ফুঁটে উঠলো এক ঔজ্জ্বল্য দীপ্তি। তিনি শিশিরকে বুক থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, ‘তুমি এবং তোমার সহযোদ্ধাগণ সৌভাগ্যবান যে এতজন সম্মানিত বুদ্ধিজীবি স্বয়ং তোমাদের প্রত্যক্ষ এবং পরক্ষ সাহায্যকারী ছিলেন, আছেন, ইনশাআল্লাহ থাকবেন। এসব নিশ্চয় মহাপ্রজ্ঞাময় আল্লাহ তায়ালার একটি সুক্ষ্ম পরিকল্পনারই অংশ।’

‘চলুন সবাই। আমি আমার পি,এ কে আগেই ব্রিফ করেছি আজকের সমাবর্তন হবে এক ঐতিহাসিক অনুষ্ঠান। আমার লিখিত বক্তব্য সংশোধন করে নতুন আঙ্গিকে তৈরি করা হচ্ছে। আল্লাহ হয়ত অনেকবড় প্রাপ্তিসংবাদ অপেক্ষা করাচ্ছেন নব্যপ্রতিষ্ঠিত ‘মুসলিম রেনেসাঁ’র জন্য। সবার চোখে প্রশ্নবোধক কৌতূহল। শিশির কান্না শেষ হয়েছে ততক্ষণে; সেও এখন বিস্মৃত। সবকিছুই স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।
আল্লাহ তাহলে ভাল কাজে এক ‘পা’ অগ্রসর হলে এভাবেই তাঁর কাজকে দশ’পা এগিয়ে নেন? সবার দিকে চেয়ে মুখে একচিলতে হাসি এঁকে প্রেসিডেন্ট সাহেব বললেন, ‘প্রফেসরস, আমি যেমন সারপ্রাইজড হয়েছি এটাও তেমনই সারপ্রাইজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলের জন্য। লেট্স গো টু ডায়াস..’

Share with Friends

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top