গল্প: আদর্শের প্রতিফলন- ডি এইচ শিশির

আদর্শের প্রতিফলন

গল্প: আদর্শের প্রতিফলন

ডি এইচ শিশির

রাতের শেষ প্রহর। চারিদিক মুখর হয়ে আছে ঝিঝিপোকার নিরবিচ্ছিন্ন ডাকে। সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন শুধু জেগে আছেন আফসানা বেগম। শুয়ে-শুয়ে বিছানায় এদিক ওদিক করছেন তিনি। মাঝেমাঝে রাতের নিশুতি নীরবতাকে খণ্ডবিখণ্ড করে ভয়ঙ্কর বিশ্রী শব্দ করে কোথায় যেন ডেকে উঠছে কোনো এক নিশাচর পাখি। প্রায়ই গভীর রাতে যখন উনি কারণে-অকারণে জেগে ওঠেন তখন শুনতে পান হৃদয় আলোড়ন করা করুণস্বরের এই ডাক। এই অচেনা পাখিটার নাম জানেন না উনি, জানার কোনো ইচ্ছে ও জাগে না কখনো। তবুও কেন যেন এই ডাক রাতের নীরবতা ভেঙে একখণ্ড ভয়ের তীর হয়ে উনার দিকে ছুটে আসে; মনে এসে ধুক করে আঘাত হানে। রাতের অখণ্ড নীরবতার সাথে পাল্লাদিয়ে উনার বুকের মধ্যে জেগে উঠছে বিন্দুবিন্দু কষ্ট। প্রথমে মনের মধ্যে গোপন কোনো সঞ্চয়কোষে তা জমা হচ্ছে তারপর ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেহে। শূন্যতাবোধে হাহাকার করছে মন। আপনজনের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হলে এমনই হয়। যেন বুকের বামপাশটাতে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হয়।

আর সেই আপনজন যদি হয় নাড়ি ছেঁড়া ধণ তবে তো কথাই নেই। এসব সাতপাঁচ ভাবছিলেন, এরইমাঝে হঠাৎ করে আফসানা রুবাইয়াতের মনের আঙিনায় ভেসে উঠল অসংখ্য স্মৃতি। নিকষকালো আঁধারের মাঝে স্মৃতিগুলো যেন একএকটি রঙিন ফাইল হয়ে ছায়ার মতো দুলছে উনার সামনে; আলতো স্পর্শ করলেই তা দৃশ্যমান হবে। আফসানা রুবাইয়াৎ অদৃষ্টের পাতাতেই দোদুল্যমান ফাইলগুলো থেকে প্রথমদৃশ্যপট দেখে একটি ফ্রেমে স্পর্শ করলেন যা থেকে নিয়নবাতির মতো হাসি-খুশি-কষ্ট আর পবিত্র ভালোবাসার অনুভূতিগুলোর মৃদু বিচ্ছুরণ ঘটছে। একটি ছোট্ট বাবুকে আদর করে বুকের দুগ্ধ দিচ্ছে সদ্য মাতৃত্বের স্বাদ আস্বাদন করা একটি মেয়ে, আফসানা রুবাইয়াৎ। আর আফসানার মুখে ছোট্টছোট্ট ফলেরটুকরো তুলে দিচ্ছে ওর স্বামী আফনান আরিফ। আফসানা ফলেরটুকরো থেকে অর্ধেক খাচ্ছে আর বাকিটুকু তুলে দিচ্ছে আরিফের মুখে। একজন আরেকজনকে খাইয়ে দিচ্ছে আর মিটিমিটি হাসছে দু’জনা। এভাবে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ফুঁটে উঠছে অকৃত্রিম ভালোবাসার দৃশ্য। খাওয়া শেষ হলো। ছোট্ট বাবুটা ঘুমাচ্ছে। হারিকেনের নিভুনিভু রক্তিম আলোতে আফসানা এবং আরিফ একজন আরেকজনের মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। যেন চোখের ভাষায় জন্মজন্মান্তরের কথা বলছে আর হারিয়ে যাচ্ছে পবিত্র ভালোবাসার মাঝে।

দুজনেরই চোখে-মুখে আনন্দের মিশ্রণ আর তরূণী আফসানা রুবাইয়াতের সুন্দর মুখ অপার মুগ্ধতায় আরও অপরুপ হয়ে উঠেছে। অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা তার মুগ্ধ দৃষ্টি থেকে ভালোবাসা আর আদরের বন্যা ছুটছে আফনান আরিফের প্রতি। আরিফও চোখের ভাষায় হৃদয় উজাড় করে দিচ্ছে আফসানার জন্য। ঘড়িরকাঁটার টিকটিক শব্দের সাথে একই ছন্দে তাল মিলিয়ে রাতের আঁধারের মাঝে মিলিয়ে যায় দিনের ঝলমলে আলো তারপর আবার ভোরের নতুন আলোর মাঝে কোথায় যেন নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় সে আঁধারের ঘনঘটা। এভাবেই তাদের একমাত্র সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতকে কেন্দ্র করে সামনের দিকে চলছিল তাদের আদর, আহ্লাদ আর অকৃত্রিম ভালোবাসায় পূর্ণ জীবন। আরিফ গ্রামের একজন স্বল্প শিক্ষিত ছেলে। ওরা গরীব হলেও সম্মান প্রতিপত্তিতে সম্ভ্রান্ত। পারিবারিকভাবেও তারা মোটামুটি সচ্ছল। রক্ষণশীল ধার্মিক হওয়ায় ওদের চাওয়া খুব কম, মোটামুটি দিন এনে দিন খেয়ে দিনযাপনই ছিল ওদের লক্ষ্য। সঞ্চয়ের ব্যাপারে কখনো ওকে তেমন একটা ভাবতে দেখেনি আফসানা।

তাই তো আর্থিকভাবে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে হয়েও আরিফকে খুব পছন্দ করত। আর তাই পরিবারের অমতেই আরিফের সাথে পরিণয়ের সুতায় নিজেকে বেঁধে ফেলেছিল। ওদের মাঝে ছিল নিশ্ছিদ্র ভালোবাসা তাই তো আফসানার পরিবারের সৃষ্ট তীব্র ঝড়ঝাপটাও ওদেরকে আলাদা করতে পারেনি। ভালোবাসার দৃঢ়তা ই তাদের পবিত্র বন্ধনকে অটুট রেখেছিল। খুবই স্বাচ্ছন্দ্যে কেটে যাচ্ছিল তাদের দিনগুলো। তাদের একমাত্র ছেলেটার নাম আফনান লিখন। বাবা- মায়ের আদরযত্নে ছোট্ট আদুরে পুতুলের মতোই বেড়ে উঠছিল তাদের স্নেহেরধণ। তখন সংসারজুড়ে ছিলো সুখের বন্যা। সবমিলিয়ে তাদের দুটি হৃদয়ের ভালোবাসা পূর্ণতা পেয়েছিলো। বলা হয় সবার কপালে অতিরিক্ত সুখ, ভালোবাসা ‘সহেনা’ ।

ঠিক তেমনই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছিল অপার সুখসমৃদ্ধ তিনটি গোলাপকলির জীবনে। আরিফ এবং আফসানার হৃদয়ের পুত্তুলি লিখনের বয়স তখন দুইবছর। একদিন সুস্পষ্ট কারণ ছাড়াই ভালোবাসার মানুষগুলোকে মায়ায় বেঁধে অন্যভূবনে, অনন্তেরপথে পাড়ি জমালো আরিফ। যেন দুচোখ ভরা স্বপ্ন আর অসীম ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে গাঁথা সাজানো গোছানো সংসার ভেঙে তছনছ হয়ে গেলো। অকস্মাৎ এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় নির্বাক হয়ে গিয়েছিল আফসানা। জাজ্বল্যমান পূর্ণিমারচাঁদটি হঠাৎ করেই ঘনকালো মেঘের অন্তরালে মুখ লুকালে পৃথিবী যেমন অমাবস্যার আঁধারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে ঠিক তেমনি আঁধারে ঢেকে গিয়েছিলো আফসানার জীবন। জীবন্মৃত হয়ে গিয়েছিল ও। ব্যথাগুলো জমাটবদ্ধ হয়ে মনের আঙিনায় গেঁথে থাকলেও একটা সময় ফিরে আসে জীবনপথে চলার ছন্দ। তেমনিভাবে ফিরে এসেছিল আফসানার জীবনেও।

ঠিক এসেছিল নয় আসতে বাধ্য করেছিল আরিফের অসমাপ্ত স্বপ্নগুলো। আফসানা যখন সাথীছাড়া জীবনকে অর্থহীন ভাবছিল তখন ওর স্মৃতিতে এসে হাতছানি দিচ্ছিল আরিফের অপূর্ণ চাওয়াগুলো। সেগুলো যেন চিৎকার করে বলছিল আমি তোমাকে ছেড়ে চলে এসেছি ঠিকই কিন্তু আমাদের দু’জনের জীবন প্রদীপকে তো জ্বালিয়ে রেখে এসেছি। আজ আমি নেই, তাই সে প্রদীপটাকে জান্নাতিআভা বিকিরণকারী দীপ্তিময় করে গড়ে তোলার দায়িত্ব এখন সম্পূর্ণ তোমার। যদি এই অশান্ত, উৎকণ্ঠী আত্মাকে জান্নাতি শান্তির স্পর্শ দিতে চাও তবে ভেঙে পড়ো না দায়িত্বশীল হও, নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন কর।

হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হওয়া কথাগুলোই আফসানাকে উজ্জীবিত করল। ও লিখনকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে ব্রতী হল। সেকারণেই আফসানা ওর পরিবার থেকে দ্বিতীয় বিবাহের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল এবং স্বামীর স্বপ্নপূরণের মাধ্যমে ছেলের জীবন গড়তে নিজের স্বাদ আহ্লাদ জলাঞ্জলি দিল। নিজেকে নিয়োজিত করল অচেনা জীবনযুদ্ধে। একটু স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করা যে কতটা কষ্টসাধ্য আফসানা তা বুঝতে পারলো জীবনযুদ্ধে নামার পর।

নিজের ইচ্ছায় পরিণয়ের সুতায় নিজেকে বেঁধেছিল তারপর আবার দ্বিতীয় বিবাহের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার কারণে পিতার পরিবার থেকে সাহায্য-সহযোগিতার শেষ আশার আলোটুকুও নিভে গেল। এদিকে স্বামীগৃহ থেকে নিজেদের ভাগে মাত্র দু’বিঘা জমি পেয়েছে ওরা। এভাবে যেদিকেই ওরা তাকাতো চারিদিকে শুধু নিরাশা ছাড়া আর কিছুই পেতনা। শুধু একটা মানুষের বিয়োজন দুটো মানুষের জীবনের গতিপথ বদলে দিয়েছে । শূন্যতা চতুর্দিক থেকে ওদের আচ্ছাদিত করেছে। অল্প কয়েকদিন আগেও পৃথিবী নামক যেই সমুদ্র অপরূপ সৌন্দর্যময় আর রোদ্দুর ঝলমলে দিন হয়ে ওদেরকে হাতছানি দিয়ে ডাকত তা হঠাৎ করেই যেন বদলে গেল ভৎসনার অবগাহনে।

কিন্তু চতুর্দিকের শত কণ্টকাকীর্ণতা আফসানাকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি। স্রষ্টব্য সাহায্য যেন এমনই হয়। সোনার চামচ মুখে নিয়ে বড় হওয়া আফসানা রুবাইয়াৎ বংশীয় অহমিকা দেখায়নি কখনো। আফসানা একজন ধনীর দুলালী তা যেন ভুলেই গেছে। ওর দু’চোখে ছিল শুধুই সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন। তাই শশুরবাড়ি থেকে স্বামীর অংশের যে জমিটুকু পেয়েছে তাতে খণ্ডখণ্ড করে বিভিন্ন ধরণের সবজি চাষ করতে লাগলো। বাড়ির আঙিনা থেকে একটুখানি মেঠো পথ পাড়ি দিলেই সেই জমি। আফসানা লিখনকে নিয়ে সারাক্ষণ সেখানেই সময় দিত আর তা থেকে প্রাপ্ত সীমিত অর্থ দিয়েই আল্লাহর রহমতে স্বাচ্ছন্দ্যে তাদের জীবন অতিবাহিত হতে লাগলো। লিখন যখন একটু বড় হলো। প্রত্যহ সকালে মায়ের ডাকে ওর ঘুমভাঙতো। আম্মু সুন্দর করে অজু করিয়ে পাশে দাঁড় করিয়ে নামাজ পড়া শেখাত। নামাজ শেষ হতেই প্রভাতরশ্মি ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই প্রথমে তাদের সোনারটুকরো জমিতে চলে যেত। জমির আইলে সবুজ ঘাসে জমে থাকা স্নিগ্ধ শিশিরের সাথে কিছুক্ষণ খেলা করত। নানারকম গল্প করত লকলকে লাউয়েরডগায় থরেথরে ফুঁটে থাকা হলুদ ফুলের সাথে। ফুলের উপর বসে থাকা রঙবেরঙ এর প্রজাপতিদের সাথে।

ঝিঙেফুলের পাশে বসে শিস দেওয়া দোয়েলপাখির সাথেও ছিল লিখনের খুব ভাব। কিছুক্ষণ পর ফল-ফুল, পাখি আর প্রজাপতি বন্ধুদেরকে বিদায় জানিয়ে মায়ের কাছে এসে পড়তে বসত লিখন। আম্মু ওকে আদর করে বাড়িরকাজ করিয়ে কপালে চুমু এঁকে দিয়ে পাঠিয়ে দিত স্কুলে। ছোট্ট লিখন ছিল ভারি দুষ্টু। লিখনের বন্ধুরা সাদারঙের পরিষ্কার স্কুলড্রেস পরে ওর পাশে বসলে সেদিন আর তার রক্ষা নেই। লিখন তার ড্রেসটাকে রাফখাতা বানিয়ে নিত। পেন্সিল দিয়ে দাগিয়ে, রঙ মাখিয়ে তাকে সঙ বানিয়ে দিত। এরপর যখন একটু বড় হলো, মায়ের মহতী স্বপ্ন আর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার অক্লান্ত চেষ্টা লিখনকে অভাবনীয় পরিবর্তনের ছোঁয়া দিল। আফসানা রুবাইয়াৎ জানত যে, যদি এই কিশোর বয়সে ওকে কন্ট্রোল করা না যায় তাহলে হয়ত ও একেবারেই অনিয়ন্ত্রিত হয়ে গড়ে উঠবে।

তাই তিনি ওকে ছোট্ট থেকেই চেষ্টা করতে লাগলেন, পাঠ্যবিষয়ের পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে। এভাবেই সবচাইতে দুষ্টু ছেলেটা হয়ে গেল সবচাইতে মেধাবি, অনুপম চরিত্রের অধিকারী এবং নৈতিকতায় অনন্য ছাত্র। আস্তে আস্তে ভাবনার রেশ কেটে গেল। রঙিন আলোয় ঘেরা স্বপ্নিল ঘটনাবলি রঙ হারালো। আঁধারের মাঝে বসেই আঁচলে চোখ মুছলেন আফসানা রুবাইয়াৎ। আঁচলের দিকে মন নিবদ্ধ হতেই আবার তার মনে পড়ল একখণ্ড স্মৃতি। লিখন পড়ত আর উত্তরের ফুরফুরে বাতাসে প্রদীপখানা যখন নিভু নিভু করত তখন আফসানা শাড়ির আঁচল দিয়ে তা ঢেকে রাখত যেন নিভে না যায়। লিখন পড়ত আর মা রাতজেগে থাকতো ওর সাথে যেন পেঁচার ভুতুড়ে ডাকে ও ভয় না পায়। এভাবে একটার পর একটা মুহূর্ত অবর্ণনীয় ত্যাগ তিতিক্ষায় গাঁথা মালা হলো লিখন। যার প্রতিটা খুশির নিঃশ্বাস, বাঁধাহীন টিকটিক হৃদস্পন্দনেও অনাবিল সুখ খুঁজে পায় আফসানা। বহুদূর থেকে বাতাসের সাথে ভেসে আসছে আজানের মুহুর্মুহু সূর। আফসানার হৃদয় আন্দোলিত করছে সে সূরের কলতান। স্মৃতিপটে ভেসে উঠলো এইতো কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া স্মৃতি। তারুণ্যের ছোঁয়া পেয়ে বেশিরভাগ ছেলেরা যখন নৈতিক অধঃপতনের শেষ দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে ঠিক তখনও শৈশবকাল থেকে ধর্মীয় পরিবেশে গড়ে ওঠা লিখনের চালচলন ছিল একদম ভিন্ন। ফজরের আজানের ধ্বনি ‘আসসালাতু খইরুম-মিনান-নাউম।’ কর্ণকুহরস্পর্শ করার সাথে- সাথেই ও বিছানা ত্যাগ করত। তারপর আম্মাকে জাগিয়ে প্রতিবেশী সমবয়সী, ছোটবড় সবার বাড়িতে গিয়ে নামাজের জন্য ঘুমথেকে ডেকে তুলত। আফসানা রুবাইয়াৎ কোনো কোনো দিন আগেই জেগে উঠতেন কিন্তু ছেলের কাজে উৎসাহ দেওয়ার অভিপ্রায়ে দু’তিন ডাক দেবার পর সাড়া দিতেন।

লিখন আম্মাকে নামাজের জন্য ডেকে সালাম বিনিময় করে চলে যেতো অন্যদের ডাকতে। তখন অজান্তেই ছেলেকে এমনভাবে মহৎ কাজে নিয়োজিত করতে পেরে উনার দু’চোখ থেকে ঝরঝর করে অশ্রুকণা নেমে আসত মহিমান্বিত প্রভুর জন্য প্রশংসা হয়ে। লিখনকে সবাই পছন্দ করে। তার আম্মার কাছে এসে অনেকে যখন আক্ষেপ করে বলে, ‘আহ! বুবু, তুমি কতই না সৌভাগ্যবতী। এমন একটা সোনারটুকরো ছেলের মা হয়েছ। কী সুন্দর তাঁর আচার ব্যবহার! দেখবা, আমাদের লিখন একদিন অনেক বড় হবে।’ কথাগুলো যখন শুনত তখন অদৃশ্যভাবেই আফসানা রুবাইয়াতের মাথা সেজদায় নুইয়ে পড়ত আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপনার্থে। আর মনটা প্রসন্ন হত স্বামীর স্বপ্নগুলোর পূর্ণতা হতে দেখে। সবকিছুই চলছিল ঠিকঠাক মতো। সময়ের পরিক্রমায় একটাসময় পড়াশুনাও শেষ হলো লিখনের। ছোট্ট ছেলেটি আজ পরিবারের দায়িত্বভার নেওয়ার জন্য প্রস্তুত। নিজের যোগ্যতানুযায়ী একটা চাকরির জন্য খুব পরিশ্রম করতে লাগলো ও। লিখন ভালোভাবেই অবহিত যে, ওর শেখা প্রতিটাকণা শিক্ষার পিছনে রয়েছে মায়ের সীমাহীন পরিশ্রম, ত্যাগ। তাই ও মনেমনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং সচেতন যে, এমন অযাচিত কিছু যেন ওর দ্বারা কখনওই সংগঠিত না হয় যাতে করে মায়ের এই অনন্য ত্যাগ, কষ্টগুলো আল্লাহর কাছে মূল্যহীন হয়ে যায়। বরং ও পাঁচওয়াক্ত নামাজে, গভীররাতে চারিদিকে যখন নিস্তব্ধতা বিরাজ করে তখন চোখের অশ্রু নিপতন করে আল্লাহ্ তায়ালার কাছে রাসূল (স)- এর শিখিয়ে দেওয়া দোয়ার মাধ্যমে ওর আব্বা- আম্মার জন্য দুনিয়া ও আখেরাতের সর্বোচ্চ প্রতিদান প্রার্থনা করে। চারিদিকে মানুষ যখন অশান্তি, সুখহীণতার কথা বলত তখন শত আর্থিক সমস্যাসংকুলতায়ও আফসানা রুবাইয়াতের মনে কখনওই অশান্তিজনক অনুভূতি সৃষ্টি হত না। উনি কঠিন বিপদেও আল্লাহ্কে স্মরণ করেন, বিশ্বাস রাখেন উনিই একমাত্র উত্তরণকর্তা। আর বিপদআপদ মু’মিনের জন্য পরীক্ষা।

এজন্য আল্লাহর অপার করুণায় স্বাচ্ছন্দ্যে কেটে যাচ্ছিল উনাদের জীবন। বিছানায় উঠে বসলেন আফসানা রুবাইয়াৎ। খুবজোরে ধড়ফড় করে নিঃশ্বাসপ্রশ্বাস ওঠানামা করছে বুকেরমধ্যে। ভাবতে লাগলেন, ‘তাই তো, আল্লাহর রহমতে খুব ভালো ভাবেই তো কেটে যাচ্ছিল আমাদের জীবন। তাহলে আমি জেনে-বুঝে এমন ভুল কিভাবে করলাম? ওয়াস্তাগফিরুল্লাহ্! শয়তানের ধোঁকায় পড়ে সন্তানের সুখের কথা চিন্তা করে ওকে আমি জাহান্নামের পথে ঠেলে দিলাম? ও আল্লাহ্‌! এ এ আমি কী করলাম!’ ডুকরে কেঁদে উঠলেন উনি। অনিচ্ছাকৃতভাবেই লিখনের অজান্তেই উনি একটি গুরুতর অন্যায় করে ফেলেছেন। কয়েকদিন আগে লিখনের জন্য ভালো একটি চাকরির বিষয়ে একজনের সাথে কথাবার্তা বলেছিলেন উনি। কিন্তু তার জন্য অনেকটাকা ঘুষ চেয়েছিলেন সেই ব্যক্তি। তারই পরামর্শে আফসানা রুবাইয়াৎ স্বামীর রেখে যাওয়া দু’বিঘা জমির থেকে দেড় বিঘা জমি বিক্রি করে দেন। এরপর গোপনে সেইটাকা লিখনের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন ঢাকাতে।

লিখনকে বলেছিলেন খুব সযত্নে ব্যাগপত্র সংরক্ষণ করে গন্তব্যে পৌঁছতে তারপর তার আংকেলের পরামর্শ মতো কাজ করতে। লিখনও উনার কথামতো তাই করবে বলেছিল। ও জানতো না যে, ব্যাগে টাকা আছে। আজ প্রায় দশদিন হয়ে গেছে লিখন বাসায়ও ফেরেনি, আবার কোনো খোঁজখবরও পাঠায়নি। আফসানা রুবাইয়াৎ এতদিন তো শুধু লিখনের চিন্তায় অস্থির ছিলেন যে, কখন সে ফিরে আসবে? কিন্তু এখন আরও একটি গুরুতর চিন্তা এসে ভর করল উনার মনে। মনেমনে শুধু একটাই অনুশোচনা হচ্ছে যে, ও ফিরলে ওকে কী জবাব দিবেন? সারাজীবন যাকে সত্য ও ন্যায়ের শিক্ষা দিয়ে বড় করেছেন তাকেই ঠেলে দিলেন স্পষ্টত গোনাহের পথে! উনি বিছানা ছেড়ে উঠলেন। অজুকরে ফজরের নামাজ আদায় করে নিলেন। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে, অপরাধীর মতো হাত তুললেন আল্লাহ্ তায়ালার দরবারে। কেঁদে-কেঁদে ফরিয়াদ জানালেন যে তিনিই একমাত্র পারেন এহেন লজ্জাজনক পরিস্থিতি থেকে তাকে রক্ষা করতে।

আর তার কলিজার টুকরো সন্তানকেও হেফাজত করতে। তিনদিন পরের কথা, শহর থেকে ফিরে আসল আফনান লিখন। তখন ভোরের আলো কেবল ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। আফসানা রুবাইয়াৎ ফজরের নামাজ পড়ে জায়নামাজেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। সারাক্ষণ চিন্তায়- চিন্তায় অস্থির উনি। রাতেও ঠিকমতো ঘুম হয় না ইদানীং। তাই ব্যথিত মন আর ক্লান্ত শরীরে শুয়ে আছেন তিনি। লিখন ঘরে পা রেখেই সালাম দিয়ে ‘আম্মা’ বলে ডাক দিল। আফসানা রুবাইয়াতের তন্দ্রাভাব কেটে গেল। লিখনের ডাক যেন উনার হৃদপিণ্ডে গিয়ে আঘাত করল। উনি একবার ওর দিকে তাকিয়ে বিস্মৃত হলেন। দৃষ্টিভ্রম হলো কী, না দেখার জন্য চোখ কচলে নিয়ে আবার তাকালেন, তারপর তড়িঘড়ি করে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন লিখনকে। ওর কপালে মমতামাখা আদর করে চুমু দিয়ে হাওমাও করে কাঁদতে লাগলেন। মায়ের এমন কান্না দেখে লিখনের মনেও তোলপাড় হয়ে যেতে লাগলো। ওর চোখ বেয়েও নেমে এলো প্রস্রবণধারা। আরেকটা বিষয়ে ও ভীষণ আশ্চর্য হলো যে, আম্মা ওর চোখে চোখ রাখছেন না। আম্মার শুকিয়ে যাওয়া মুখে ও অন্যকোনো চিন্তার স্পষ্ট ছাপ পেল।

লিখন মস্তিষ্কের সমস্ত শক্তি নিয়োগ করল এর কারণ অনুসন্ধানে। ও কয়েকটা সিদ্ধান্ত দাঁড় করাল তার মধ্যে সবচাইতে জোরালো কারণ হিসেবে যেটা অনুমান করল সেটাই হলো সঠিক। লিখনের এই সঠিক চিন্তার পিছনে যে, আল্লাহর ইচ্ছে এবং ফয়সালা ছিল তা সহজেই অনুমেয়। তিনি হয়ত একজন মায়ের দোয়া এবং অনুশোচনা কবুল করেছেন। লিখন মায়ের মনের অবস্থাটাকে হাল্কা কারার জন্য উনার মলিন মুখে আলতো করে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘আম্মা, আল্লাহ যেটা করেন সত্যিকারার্থে তা বান্দার মঙ্গলের জন্যই করেন তাই না, বল? আফসানা বেগম বেশ কৌতূহল নিয়ে একবার লিখনের দিকে চেয়ে মাথানেড়ে কোমল কণ্ঠে বললেন, ‘হুমমম। তাই তো।’ লিখন বলতে আরম্ভ করল, ‘আমি সত্যিই ভীষণ দুঃখিত আম্মা, বাসায় ফিরতে দেরি করা আর কবে ফিরব তা না জানানোর জন্য। আমি ওই চাচার কাছে পৌঁছানোর পর সবকিছু স্পষ্টভাবে জানতে পারলাম যে, ঘুষের টাকার বিনিময়েই আমার চাকরিটা নিশ্চিত করা হবে। চাকরীর জন্য পরীক্ষার ব্যপারটা সম্পূর্ণ ছিলো শুধুমাত্র নিয়মরক্ষা করার নামান্তর।

টাকাগুলো দিলেই নিশ্চিত হত চাকরীটা। এটা জানার পরে আমার কিছুতেই মন মানছিলো না যে, বাবার জমি বিক্রির টাকাগুলো কোন অসৎ কাজে ব্যয় করব, যদিও উদ্দেশ্যটা ছিলো অতিপ্রয়োজনীয়। মন থেকে মানতে পারছিলাম না, কোথায় যেন একটা বাঁধা কাজ করছিলো। সেদিন ভাবছিলাম কথাগুলো তখন মনের আয়নায় ভেসে উঠলো তোমার পবিত্র মুখখানা। সেই মানুষের মুখ যিনি কখনওই অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের মাধ্যমে কঠিন বাঁধার প্রাচীর ডিঙিয়েও সন্তানকে সত্যিকারার্থে মানুষের মতো মানুষ করতে যিনি ছিলেন দৃঢ় প্রত্যয়ী। আমি সেই মায়ের সম্মান রক্ষার্থে ঘুষের বিনিময়ে চাকরীর প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দিয়ে এসেছি। তবুও মনটা বিষণ্ণ ছিলো যে, আমি আবার অজান্তেই তোমাকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম কি, না? আবার মুহূর্তে মনে হলো আমার মায়ের ঈমান আর খোদাভীরুতার কথা। হয়ত সেটা ক্ষণিকের জন্য সন্তানস্নেহে দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। এটা ভাবতেই মনটা প্রশান্তিতে ভরে গিয়েছিলো। ফেরার পথে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত এক বড়ভাইয়ের সহায়তায় একটা ব্যবসার ব্যবস্থা করে এসেছি।

দেখ, ব্যবসাটা তোমার খুবই পছন্দ হবে। আনন্দের কথা হলো এই ব্যবসার মাধ্যমে আমরা অন্তত দু’বেলা দু’মুঠো হালালরুজি খেয়ে-পরে জীবন পরিচালনা করতে পারব ইনশাআল্লাহ্।’ একটু থেমে লিখন আবার মিষ্টি হেসে বলল, ‘আল্লাহ্ আমার জন্য উত্তম ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কেমন যেন স্বপ্নের মতো। ঘুষের চাকরি করব না বলে যখন ফিরে আসতে চেয়েছিলাম তখন যেন আল্লাহ তায়ালা গায়েবী সাহায্যের মাধ্যমে একটা ব্যবস্থা ঠিকই করে দিলেন। আলহামদুলিল্লাহ্‌! যা থেকে আমরা হালাল উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারব। আর দেখেছ আম্মা, কেমনভাবে তুমি অজান্তেই একটা দূরদর্শী কাজ করে ফেললে? এটাকে বলে আল্লাহর সাহায্য। তুমি জমিবেঁচে টাকাগুলো না পাঠালে হয়ত কিছুই সম্ভব হতো না বা এই পরিকল্পনাও মাথায় আসত না। আমি জানি এসবই তোমার দোয়ার ফলেই হয়েছে। আমার মায়ের দোয়াই তো আমার জন্য অসীম সৌভাগ্যেরদ্বার।’ আফসানা রুবাইয়াৎ যেন নির্বাক হয়ে গেলেন।

প্রত্যাশার চাইতেও বেশি প্রাপ্তির পর মানুষ যেমন ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়, ঠিক তেমন। উনার মনে শতসহস্রবার একটি শব্দই শুধু প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো ‘আলহামদুলিল্লাহ্‌!’ আর ভাবতে লাগলেন, ‘আল্লাহ্ তায়ালাই আমাকে দয়া করে এমন লজ্জাজনক পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করেছেন। সাথে লিখনের জন্য এমন একটা সুন্দর ব্যবসার উপায়ও বের করে দিলেন।’ উনার চোখ থেকে নীরবে বয়ে চলা নির্ঝরধারা মুক্তারদানার মতো চিকচিক করছে। লিখন তা আদুরে হাত দিয়ে মুছে দিল। আফসানা রুবাইয়াৎ একবার লিখনের মুখে স্নেহের হাত রেখে দৌড়ে চলে গেলেন বিছানো অবস্থায় থাকা জায়নামাজের উপর। সেজদায় লুটিয়ে পড়লেন। একটু দূর থেকে মায়ের এহেন পবিত্র ভালোবাসা উপলব্ধি করে লিখনও নির্বাক। ওর চোখ দু’টিও ছলছল করছে, হয়ত এখনই মহিমান্বিত স্রষ্টার জন্য প্রশংসা হয়ে নেমে আসবে অশ্রুকণা। রাতের শেষ প্রহর। চারিদিক মুখর হয়ে আছে ঝিঝিপোকার নিরবিচ্ছিন্ন ডাকে।

সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন শুধু জেগে আছেন আফসানা বেগম। শুয়ে-শুয়ে বিছানায় এদিক ওদিক করছেন তিনি। মাঝেমাঝে রাতের নিশুতি নীরবতাকে খণ্ডবিখণ্ড করে ভয়ঙ্কর বিশ্রী শব্দ করে কোথায় যেন ডেকে উঠছে কোনো এক নিশাচর পাখি। প্রায়ই গভীর রাতে যখন উনি কারণে-অকারণে জেগে ওঠেন তখন শুনতে পান হৃদয় আলোড়ন করা করুণস্বরের এই ডাক। এই অচেনা পাখিটার নাম জানেন না উনি, জানার কোনো ইচ্ছে ও জাগে না কখনো। তবুও কেন যেন এই ডাক রাতের নীরবতা ভেঙে একখণ্ড ভয়ের তীর হয়ে উনার দিকে ছুটে আসে; মনে এসে ধুক করে আঘাত হানে। রাতের অখণ্ড নীরবতার সাথে পাল্লাদিয়ে উনার বুকের মধ্যে জেগে উঠছে বিন্দুবিন্দু কষ্ট। প্রথমে মনের মধ্যে গোপন কোনো সঞ্চয়কোষে তা জমা হচ্ছে তারপর ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেহে। শূন্যতাবোধে হাহাকার করছে মন। আপনজনের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হলে এমনই হয়। যেন বুকের বামপাশটাতে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হয়।

আর সেই আপনজন যদি হয় নাড়ি ছেঁড়া ধণ তবে তো কথাই নেই। এসব সাতপাঁচ ভাবছিলেন, এরইমাঝে হঠাৎ করে আফসানা রুবাইয়াতের মনের আঙিনায় ভেসে উঠল অসংখ্য স্মৃতি। নিকষকালো আঁধারের মাঝে স্মৃতিগুলো যেন একএকটি রঙিন ফাইল হয়ে ছায়ার মতো দুলছে উনার সামনে; আলতো স্পর্শ করলেই তা দৃশ্যমান হবে। আফসানা রুবাইয়াৎ অদৃষ্টের পাতাতেই দোদুল্যমান ফাইলগুলো থেকে প্রথমদৃশ্যপট দেখে একটি ফ্রেমে স্পর্শ করলেন যা থেকে নিয়নবাতির মতো হাসি-খুশি-কষ্ট আর পবিত্র ভালোবাসার অনুভূতিগুলোর মৃদু বিচ্ছুরণ ঘটছে। একটি ছোট্ট বাবুকে আদর করে বুকের দুগ্ধ দিচ্ছে সদ্য মাতৃত্বের স্বাদ আস্বাদন করা একটি মেয়ে, আফসানা রুবাইয়াৎ। আর আফসানার মুখে ছোট্টছোট্ট ফলেরটুকরো তুলে দিচ্ছে ওর স্বামী আফনান আরিফ। আফসানা ফলেরটুকরো থেকে অর্ধেক খাচ্ছে আর বাকিটুকু তুলে দিচ্ছে আরিফের মুখে। একজন আরেকজনকে খাইয়ে দিচ্ছে আর মিটিমিটি হাসছে দু’জনা। এ

ভাবে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ফুঁটে উঠছে অকৃত্রিম ভালোবাসার দৃশ্য। খাওয়া শেষ হলো। ছোট্ট বাবুটা ঘুমাচ্ছে। হারিকেনের নিভুনিভু রক্তিম আলোতে আফসানা এবং আরিফ একজন আরেকজনের মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। যেন চোখের ভাষায় জন্মজন্মান্তরের কথা বলছে আর হারিয়ে যাচ্ছে পবিত্র ভালোবাসার মাঝে। দুজনেরই চোখে-মুখে আনন্দের মিশ্রণ আর তরূণী আফসানা রুবাইয়াতের সুন্দর মুখ অপার মুগ্ধতায় আরও অপরুপ হয়ে উঠেছে। অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা তার মুগ্ধ দৃষ্টি থেকে ভালোবাসা আর আদরের বন্যা ছুটছে আফনান আরিফের প্রতি। আরিফও চোখের ভাষায় হৃদয় উজাড় করে দিচ্ছে আফসানার জন্য। ঘড়িরকাঁটার টিকটিক শব্দের সাথে একই ছন্দে তাল মিলিয়ে রাতের আঁধারের মাঝে মিলিয়ে যায় দিনের ঝলমলে আলো তারপর আবার ভোরের নতুন আলোর মাঝে কোথায় যেন নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় সে আঁধারের ঘনঘটা। এভাবেই তাদের একমাত্র সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতকে কেন্দ্র করে সামনের দিকে চলছিল তাদের আদর, আহ্লাদ আর অকৃত্রিম ভালোবাসায় পূর্ণ জীবন। আরিফ গ্রামের একজন স্বল্প শিক্ষিত ছেলে।

ওরা গরীব হলেও সম্মান প্রতিপত্তিতে সম্ভ্রান্ত। পারিবারিকভাবেও তারা মোটামুটি সচ্ছল। রক্ষণশীল ধার্মিক হওয়ায় ওদের চাওয়া খুব কম, মোটামুটি দিন এনে দিন খেয়ে দিনযাপনই ছিল ওদের লক্ষ্য। সঞ্চয়ের ব্যাপারে কখনো ওকে তেমন একটা ভাবতে দেখেনি আফসানা। তাই তো আর্থিকভাবে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে হয়েও আরিফকে খুব পছন্দ করত। আর তাই পরিবারের অমতেই আরিফের সাথে পরিণয়ের সুতায় নিজেকে বেঁধে ফেলেছিল। ওদের মাঝে ছিল নিশ্ছিদ্র ভালোবাসা তাই তো আফসানার পরিবারের সৃষ্ট তীব্র ঝড়ঝাপটাও ওদেরকে আলাদা করতে পারেনি। ভালোবাসার দৃঢ়তা ই তাদের পবিত্র বন্ধনকে অটুট রেখেছিল। খুবই স্বাচ্ছন্দ্যে কেটে যাচ্ছিল তাদের দিনগুলো। তাদের একমাত্র ছেলেটার নাম আফনান লিখন। বাবা- মায়ের আদরযত্নে ছোট্ট আদুরে পুতুলের মতোই বেড়ে উঠছিল তাদের স্নেহেরধণ। তখন সংসারজুড়ে ছিলো সুখের বন্যা। সবমিলিয়ে তাদের দুটি হৃদয়ের ভালোবাসা পূর্ণতা পেয়েছিলো। বলা হয় সবার কপালে অতিরিক্ত সুখ, ভালোবাসা ‘সহেনা’ । ঠিক তেমনই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছিল অপার সুখসমৃদ্ধ তিনটি গোলাপকলির জীবনে। আরিফ এবং আফসানার হৃদয়ের পুত্তুলি লিখনের বয়স তখন দুইবছর। একদিন সুস্পষ্ট কারণ ছাড়াই ভালোবাসার মানুষগুলোকে মায়ায় বেঁধে অন্যভূবনে, অনন্তেরপথে পাড়ি জমালো আরিফ। যেন দুচোখ ভরা স্বপ্ন আর অসীম ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে গাঁথা সাজানো গোছানো সংসার ভেঙে তছনছ হয়ে গেলো। অকস্মাৎ এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় নির্বাক হয়ে গিয়েছিল আফসানা। জাজ্বল্যমান পূর্ণিমারচাঁদটি হঠাৎ করেই ঘনকালো মেঘের অন্তরালে মুখ লুকালে পৃথিবী যেমন অমাবস্যার আঁধারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে ঠিক তেমনি আঁধারে ঢেকে গিয়েছিলো আফসানার জীবন। জীবন্মৃত হয়ে গিয়েছিল ও। ব্যথাগুলো জমাটবদ্ধ হয়ে মনের আঙিনায় গেঁথে থাকলেও একটা সময় ফিরে আসে জীবনপথে চলার ছন্দ।

তেমনিভাবে ফিরে এসেছিল আফসানার জীবনেও। ঠিক এসেছিল নয় আসতে বাধ্য করেছিল আরিফের অসমাপ্ত স্বপ্নগুলো। আফসানা যখন সাথীছাড়া জীবনকে অর্থহীন ভাবছিল তখন ওর স্মৃতিতে এসে হাতছানি দিচ্ছিল আরিফের অপূর্ণ চাওয়াগুলো। সেগুলো যেন চিৎকার করে বলছিল আমি তোমাকে ছেড়ে চলে এসেছি ঠিকই কিন্তু আমাদের দু’জনের জীবন প্রদীপকে তো জ্বালিয়ে রেখে এসেছি। আজ আমি নেই, তাই সে প্রদীপটাকে জান্নাতিআভা বিকিরণকারী দীপ্তিময় করে গড়ে তোলার দায়িত্ব এখন সম্পূর্ণ তোমার। যদি এই অশান্ত, উৎকণ্ঠী আত্মাকে জান্নাতি শান্তির স্পর্শ দিতে চাও তবে ভেঙে পড়ো না দায়িত্বশীল হও, নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন কর। হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হওয়া কথাগুলোই আফসানাকে উজ্জীবিত করল। ও লিখনকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে ব্রতী হল। সেকারণেই আফসানা ওর পরিবার থেকে দ্বিতীয় বিবাহের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল এবং স্বামীর স্বপ্নপূরণের মাধ্যমে ছেলের জীবন গড়তে নিজের স্বাদ আহ্লাদ জলাঞ্জলি দিল। নিজেকে নিয়োজিত করল অচেনা জীবনযুদ্ধে। একটু স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করা যে কতটা কষ্টসাধ্য আফসানা তা বুঝতে পারলো জীবনযুদ্ধে নামার পর। নিজের ইচ্ছায় পরিণয়ের সুতায় নিজেকে বেঁধেছিল তারপর আবার দ্বিতীয় বিবাহের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার কারণে পিতার পরিবার থেকে সাহায্য-সহযোগিতার শেষ আশার আলোটুকুও নিভে গেল।

এদিকে স্বামীগৃহ থেকে নিজেদের ভাগে মাত্র দু’বিঘা জমি পেয়েছে ওরা। এভাবে যেদিকেই ওরা তাকাতো চারিদিকে শুধু নিরাশা ছাড়া আর কিছুই পেতনা। শুধু একটা মানুষের বিয়োজন দুটো মানুষের জীবনের গতিপথ বদলে দিয়েছে । শূন্যতা চতুর্দিক থেকে ওদের আচ্ছাদিত করেছে। অল্প কয়েকদিন আগেও পৃথিবী নামক যেই সমুদ্র অপরূপ সৌন্দর্যময় আর রোদ্দুর ঝলমলে দিন হয়ে ওদেরকে হাতছানি দিয়ে ডাকত তা হঠাৎ করেই যেন বদলে গেল ভৎসনার অবগাহনে। কিন্তু চতুর্দিকের শত কণ্টকাকীর্ণতা আফসানাকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি। স্রষ্টব্য সাহায্য যেন এমনই হয়। সোনার চামচ মুখে নিয়ে বড় হওয়া আফসানা রুবাইয়াৎ বংশীয় অহমিকা দেখায়নি কখনো। আফসানা একজন ধনীর দুলালী তা যেন ভুলেই গেছে। ওর দু’চোখে ছিল শুধুই সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন।

তাই শশুরবাড়ি থেকে স্বামীর অংশের যে জমিটুকু পেয়েছে তাতে খণ্ডখণ্ড করে বিভিন্ন ধরণের সবজি চাষ করতে লাগলো। বাড়ির আঙিনা থেকে একটুখানি মেঠো পথ পাড়ি দিলেই সেই জমি। আফসানা লিখনকে নিয়ে সারাক্ষণ সেখানেই সময় দিত আর তা থেকে প্রাপ্ত সীমিত অর্থ দিয়েই আল্লাহর রহমতে স্বাচ্ছন্দ্যে তাদের জীবন অতিবাহিত হতে লাগলো। লিখন যখন একটু বড় হলো। প্রত্যহ সকালে মায়ের ডাকে ওর ঘুমভাঙতো। আম্মু সুন্দর করে অজু করিয়ে পাশে দাঁড় করিয়ে নামাজ পড়া শেখাত। নামাজ শেষ হতেই প্রভাতরশ্মি ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই প্রথমে তাদের সোনারটুকরো জমিতে চলে যেত। জমির আইলে সবুজ ঘাসে জমে থাকা স্নিগ্ধ শিশিরের সাথে কিছুক্ষণ খেলা করত। নানারকম গল্প করত লকলকে লাউয়েরডগায় থরেথরে ফুঁটে থাকা হলুদ ফুলের সাথে। ফুলের উপর বসে থাকা রঙবেরঙ এর প্রজাপতিদের সাথে। ঝিঙেফুলের পাশে বসে শিস দেওয়া দোয়েলপাখির সাথেও ছিল লিখনের খুব ভাব।

কিছুক্ষণ পর ফল-ফুল, পাখি আর প্রজাপতি বন্ধুদেরকে বিদায় জানিয়ে মায়ের কাছে এসে পড়তে বসত লিখন। আম্মু ওকে আদর করে বাড়িরকাজ করিয়ে কপালে চুমু এঁকে দিয়ে পাঠিয়ে দিত স্কুলে। ছোট্ট লিখন ছিল ভারি দুষ্টু। লিখনের বন্ধুরা সাদারঙের পরিষ্কার স্কুলড্রেস পরে ওর পাশে বসলে সেদিন আর তার রক্ষা নেই। লিখন তার ড্রেসটাকে রাফখাতা বানিয়ে নিত। পেন্সিল দিয়ে দাগিয়ে, রঙ মাখিয়ে তাকে সঙ বানিয়ে দিত। এরপর যখন একটু বড় হলো, মায়ের মহতী স্বপ্ন আর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার অক্লান্ত চেষ্টা লিখনকে অভাবনীয় পরিবর্তনের ছোঁয়া দিল। আফসানা রুবাইয়াৎ জানত যে, যদি এই কিশোর বয়সে ওকে কন্ট্রোল করা না যায় তাহলে হয়ত ও একেবারেই অনিয়ন্ত্রিত হয়ে গড়ে উঠবে। তাই তিনি ওকে ছোট্ট থেকেই চেষ্টা করতে লাগলেন, পাঠ্যবিষয়ের পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে। এভাবেই সবচাইতে দুষ্টু ছেলেটা হয়ে গেল সবচাইতে মেধাবি, অনুপম চরিত্রের অধিকারী এবং নৈতিকতায় অনন্য ছাত্র।

 

আস্তে আস্তে ভাবনার রেশ কেটে গেল। রঙিন আলোয় ঘেরা স্বপ্নিল ঘটনাবলি রঙ হারালো। আঁধারের মাঝে বসেই আঁচলে চোখ মুছলেন আফসানা রুবাইয়াৎ। আঁচলের দিকে মন নিবদ্ধ হতেই আবার তার মনে পড়ল একখণ্ড স্মৃতি। লিখন পড়ত আর উত্তরের ফুরফুরে বাতাসে প্রদীপখানা যখন নিভু নিভু করত তখন আফসানা শাড়ির আঁচল দিয়ে তা ঢেকে রাখত যেন নিভে না যায়। লিখন পড়ত আর মা রাতজেগে থাকতো ওর সাথে যেন পেঁচার ভুতুড়ে ডাকে ও ভয় না পায়। এভাবে একটার পর একটা মুহূর্ত অবর্ণনীয় ত্যাগ তিতিক্ষায় গাঁথা মালা হলো লিখন।

যার প্রতিটা খুশির নিঃশ্বাস, বাঁধাহীন টিকটিক হৃদস্পন্দনেও অনাবিল সুখ খুঁজে পায় আফসানা। বহুদূর থেকে বাতাসের সাথে ভেসে আসছে আজানের মুহুর্মুহু সূর। আফসানার হৃদয় আন্দোলিত করছে সে সূরের কলতান। স্মৃতিপটে ভেসে উঠলো এইতো কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া স্মৃতি। তারুণ্যের ছোঁয়া পেয়ে বেশিরভাগ ছেলেরা যখন নৈতিক অধঃপতনের শেষ দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে ঠিক তখনও শৈশবকাল থেকে ধর্মীয় পরিবেশে গড়ে ওঠা লিখনের চালচলন ছিল একদম ভিন্ন। ফজরের আজানের ধ্বনি ‘আসসালাতু খইরুম-মিনান-নাউম।’

কর্ণকুহরস্পর্শ করার সাথে- সাথেই ও বিছানা ত্যাগ করত। তারপর আম্মাকে জাগিয়ে প্রতিবেশী সমবয়সী, ছোটবড় সবার বাড়িতে গিয়ে নামাজের জন্য ঘুমথেকে ডেকে তুলত। আফসানা রুবাইয়াৎ কোনো কোনো দিন আগেই জেগে উঠতেন কিন্তু ছেলের কাজে উৎসাহ দেওয়ার অভিপ্রায়ে দু’তিন ডাক দেবার পর সাড়া দিতেন। লিখন আম্মাকে নামাজের জন্য ডেকে সালাম বিনিময় করে চলে যেতো অন্যদের ডাকতে। তখন অজান্তেই ছেলেকে এমনভাবে মহৎ কাজে নিয়োজিত করতে পেরে উনার দু’চোখ থেকে ঝরঝর করে অশ্রুকণা নেমে আসত মহিমান্বিত প্রভুর জন্য প্রশংসা হয়ে। লিখনকে সবাই পছন্দ করে। তার আম্মার কাছে এসে অনেকে যখন আক্ষেপ করে বলে, ‘আহ! বুবু, তুমি কতই না সৌভাগ্যবতী। এমন একটা সোনারটুকরো ছেলের মা হয়েছ। কী সুন্দর তাঁর আচার ব্যবহার! দেখবা, আমাদের লিখন একদিন অনেক বড় হবে।’ কথাগুলো যখন শুনত তখন অদৃশ্যভাবেই আফসানা রুবাইয়াতের মাথা সেজদায় নুইয়ে পড়ত আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপনার্থে। আর মনটা প্রসন্ন হত স্বামীর স্বপ্নগুলোর পূর্ণতা হতে দেখে। সবকিছুই চলছিল ঠিকঠাক মতো। সময়ের পরিক্রমায় একটাসময় পড়াশুনাও শেষ হলো লিখনের। ছোট্ট ছেলেটি আজ পরিবারের দায়িত্বভার নেওয়ার জন্য প্রস্তুত।

নিজের যোগ্যতানুযায়ী একটা চাকরির জন্য খুব পরিশ্রম করতে লাগলো ও। লিখন ভালোভাবেই অবহিত যে, ওর শেখা প্রতিটাকণা শিক্ষার পিছনে রয়েছে মায়ের সীমাহীন পরিশ্রম, ত্যাগ। তাই ও মনেমনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং সচেতন যে, এমন অযাচিত কিছু যেন ওর দ্বারা কখনওই সংগঠিত না হয় যাতে করে মায়ের এই অনন্য ত্যাগ, কষ্টগুলো আল্লাহর কাছে মূল্যহীন হয়ে যায়। বরং ও পাঁচওয়াক্ত নামাজে, গভীররাতে চারিদিকে যখন নিস্তব্ধতা বিরাজ করে তখন চোখের অশ্রু নিপতন করে আল্লাহ্ তায়ালার কাছে রাসূল (স)- এর শিখিয়ে দেওয়া দোয়ার মাধ্যমে ওর আব্বা- আম্মার জন্য দুনিয়া ও আখেরাতের সর্বোচ্চ প্রতিদান প্রার্থনা করে। চারিদিকে মানুষ যখন অশান্তি, সুখহীণতার কথা বলত তখন শত আর্থিক সমস্যাসংকুলতায়ও আফসানা রুবাইয়াতের মনে কখনওই অশান্তিজনক অনুভূতি সৃষ্টি হত না।

উনি কঠিন বিপদেও আল্লাহ্কে স্মরণ করেন, বিশ্বাস রাখেন উনিই একমাত্র উত্তরণকর্তা। আর বিপদআপদ মু’মিনের জন্য পরীক্ষা। এজন্য আল্লাহর অপার করুণায় স্বাচ্ছন্দ্যে কেটে যাচ্ছিল উনাদের জীবন। বিছানায় উঠে বসলেন আফসানা রুবাইয়াৎ। খুবজোরে ধড়ফড় করে নিঃশ্বাসপ্রশ্বাস ওঠানামা করছে বুকেরমধ্যে। ভাবতে লাগলেন, ‘তাই তো, আল্লাহর রহমতে খুব ভালো ভাবেই তো কেটে যাচ্ছিল আমাদের জীবন। তাহলে আমি জেনে-বুঝে এমন ভুল কিভাবে করলাম? ওয়াস্তাগফিরুল্লাহ্! শয়তানের ধোঁকায় পড়ে সন্তানের সুখের কথা চিন্তা করে ওকে আমি জাহান্নামের পথে ঠেলে দিলাম? ও আল্লাহ্‌! এ এ আমি কী করলাম!’ ডুকরে কেঁদে উঠলেন উনি। অনিচ্ছাকৃতভাবেই লিখনের অজান্তেই উনি একটি গুরুতর অন্যায় করে ফেলেছেন। কয়েকদিন আগে লিখনের জন্য ভালো একটি চাকরির বিষয়ে একজনের সাথে কথাবার্তা বলেছিলেন উনি। কিন্তু তার জন্য অনেকটাকা ঘুষ চেয়েছিলেন সেই ব্যক্তি। তারই পরামর্শে আফসানা রুবাইয়াৎ স্বামীর রেখে যাওয়া দু’বিঘা জমির থেকে দেড় বিঘা জমি বিক্রি করে দেন। এরপর গোপনে সেইটাকা লিখনের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন ঢাকাতে। লিখনকে বলেছিলেন খুব সযত্নে ব্যাগপত্র সংরক্ষণ করে গন্তব্যে পৌঁছতে তারপর তার আংকেলের পরামর্শ মতো কাজ করতে। লিখনও উনার কথামতো তাই করবে বলেছিল। ও জানতো না যে, ব্যাগে টাকা আছে। আজ প্রায় দশদিন হয়ে গেছে লিখন বাসায়ও ফেরেনি, আবার কোনো খোঁজখবরও পাঠায়নি। আফসানা রুবাইয়াৎ এতদিন তো শুধু লিখনের চিন্তায় অস্থির ছিলেন যে, কখন সে ফিরে আসবে? কিন্তু এখন আরও একটি গুরুতর চিন্তা এসে ভর করল উনার মনে। মনেমনে শুধু একটাই অনুশোচনা হচ্ছে যে, ও ফিরলে ওকে কী জবাব দিবেন? সারাজীবন যাকে সত্য ও ন্যায়ের শিক্ষা দিয়ে বড় করেছেন তাকেই ঠেলে দিলেন স্পষ্টত গোনাহের পথে! উনি বিছানা ছেড়ে উঠলেন। অজুকরে ফজরের নামাজ আদায় করে নিলেন। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে, অপরাধীর মতো হাত তুললেন আল্লাহ্ তায়ালার দরবারে। কেঁদে-কেঁদে ফরিয়াদ জানালেন যে তিনিই একমাত্র পারেন এহেন লজ্জাজনক পরিস্থিতি থেকে তাকে রক্ষা করতে। আর তার কলিজার টুকরো সন্তানকেও হেফাজত করতে।

তিনদিন পরের কথা, শহর থেকে ফিরে আসল আফনান লিখন। তখন ভোরের আলো কেবল ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। আফসানা রুবাইয়াৎ ফজরের নামাজ পড়ে জায়নামাজেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। সারাক্ষণ চিন্তায়- চিন্তায় অস্থির উনি। রাতেও ঠিকমতো ঘুম হয় না ইদানীং। তাই ব্যথিত মন আর ক্লান্ত শরীরে শুয়ে আছেন তিনি। লিখন ঘরে পা রেখেই সালাম দিয়ে ‘আম্মা’ বলে ডাক দিল। আফসানা রুবাইয়াতের তন্দ্রাভাব কেটে গেল। লিখনের ডাক যেন উনার হৃদপিণ্ডে গিয়ে আঘাত করল। উনি একবার ওর দিকে তাকিয়ে বিস্মৃত হলেন। দৃষ্টিভ্রম হলো কী, না দেখার জন্য চোখ কচলে নিয়ে আবার তাকালেন, তারপর তড়িঘড়ি করে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন লিখনকে। ওর কপালে মমতামাখা আদর করে চুমু দিয়ে হাওমাও করে কাঁদতে লাগলেন। মায়ের এমন কান্না দেখে লিখনের মনেও তোলপাড় হয়ে যেতে লাগলো। ওর চোখ বেয়েও নেমে এলো প্রস্রবণধারা। আরেকটা বিষয়ে ও ভীষণ আশ্চর্য হলো যে, আম্মা ওর চোখে চোখ রাখছেন না। আম্মার শুকিয়ে যাওয়া মুখে ও অন্যকোনো চিন্তার স্পষ্ট ছাপ পেল। লিখন মস্তিষ্কের সমস্ত শক্তি নিয়োগ করল এর কারণ অনুসন্ধানে। ও কয়েকটা সিদ্ধান্ত দাঁড় করাল তার মধ্যে সবচাইতে জোরালো কারণ হিসেবে যেটা অনুমান করল সেটাই হলো সঠিক। লিখনের এই সঠিক চিন্তার পিছনে যে, আল্লাহর ইচ্ছে এবং ফয়সালা ছিল তা সহজেই অনুমেয়। তিনি হয়ত একজন মায়ের দোয়া এবং অনুশোচনা কবুল করেছেন। লিখন মায়ের মনের অবস্থাটাকে হাল্কা কারার জন্য উনার মলিন মুখে আলতো করে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘আম্মা, আল্লাহ যেটা করেন সত্যিকারার্থে তা বান্দার মঙ্গলের জন্যই করেন তাই না, বল? আফসানা বেগম বেশ কৌতূহল নিয়ে একবার লিখনের দিকে চেয়ে মাথানেড়ে কোমল কণ্ঠে বললেন, ‘হুমমম। তাই তো।’

লিখন বলতে আরম্ভ করল, ‘আমি সত্যিই ভীষণ দুঃখিত আম্মা, বাসায় ফিরতে দেরি করা আর কবে ফিরব তা না জানানোর জন্য। আমি ওই চাচার কাছে পৌঁছানোর পর সবকিছু স্পষ্টভাবে জানতে পারলাম যে, ঘুষের টাকার বিনিময়েই আমার চাকরিটা নিশ্চিত করা হবে। চাকরীর জন্য পরীক্ষার ব্যপারটা সম্পূর্ণ ছিলো শুধুমাত্র নিয়মরক্ষা করার নামান্তর। টাকাগুলো দিলেই নিশ্চিত হত চাকরীটা। এটা জানার পরে আমার কিছুতেই মন মানছিলো না যে, বাবার জমি বিক্রির টাকাগুলো কোন অসৎ কাজে ব্যয় করব, যদিও উদ্দেশ্যটা ছিলো অতিপ্রয়োজনীয়। মন থেকে মানতে পারছিলাম না, কোথায় যেন একটা বাঁধা কাজ করছিলো। সেদিন ভাবছিলাম কথাগুলো তখন মনের আয়নায় ভেসে উঠলো তোমার পবিত্র মুখখানা। সেই মানুষের মুখ যিনি কখনওই অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের মাধ্যমে কঠিন বাঁধার প্রাচীর ডিঙিয়েও সন্তানকে সত্যিকারার্থে মানুষের মতো মানুষ করতে যিনি ছিলেন দৃঢ় প্রত্যয়ী। আমি সেই মায়ের সম্মান রক্ষার্থে ঘুষের বিনিময়ে চাকরীর প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দিয়ে এসেছি। তবুও মনটা বিষণ্ণ ছিলো যে, আমি আবার অজান্তেই তোমাকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম কি, না? আবার মুহূর্তে মনে হলো আমার মায়ের ঈমান আর খোদাভীরুতার কথা।

হয়ত সেটা ক্ষণিকের জন্য সন্তানস্নেহে দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। এটা ভাবতেই মনটা প্রশান্তিতে ভরে গিয়েছিলো। ফেরার পথে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত এক বড়ভাইয়ের সহায়তায় একটা ব্যবসার ব্যবস্থা করে এসেছি। দেখ, ব্যবসাটা তোমার খুবই পছন্দ হবে। আনন্দের কথা হলো এই ব্যবসার মাধ্যমে আমরা অন্তত দু’বেলা দু’মুঠো হালালরুজি খেয়ে-পরে জীবন পরিচালনা করতে পারব ইনশাআল্লাহ্।’ একটু থেমে লিখন আবার মিষ্টি হেসে বলল, ‘আল্লাহ্ আমার জন্য উত্তম ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কেমন যেন স্বপ্নের মতো। ঘুষের চাকরি করব না বলে যখন ফিরে আসতে চেয়েছিলাম তখন যেন আল্লাহ তায়ালা গায়েবী সাহায্যের মাধ্যমে একটা ব্যবস্থা ঠিকই করে দিলেন। আলহামদুলিল্লাহ্‌! যা থেকে আমরা হালাল উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারব। আর দেখেছ আম্মা, কেমনভাবে তুমি অজান্তেই একটা দূরদর্শী কাজ করে ফেললে? এটাকে বলে আল্লাহর সাহায্য। তুমি জমিবেঁচে টাকাগুলো না পাঠালে হয়ত কিছুই সম্ভব হতো না বা এই পরিকল্পনাও মাথায় আসত না। আমি জানি এসবই তোমার দোয়ার ফলেই হয়েছে।

আমার মায়ের দোয়াই তো আমার জন্য অসীম সৌভাগ্যেরদ্বার।’ আফসানা রুবাইয়াৎ যেন নির্বাক হয়ে গেলেন। প্রত্যাশার চাইতেও বেশি প্রাপ্তির পর মানুষ যেমন ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়, ঠিক তেমন। উনার মনে শতসহস্রবার একটি শব্দই শুধু প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো ‘আলহামদুলিল্লাহ্‌!’ আর ভাবতে লাগলেন, ‘আল্লাহ্ তায়ালাই আমাকে দয়া করে এমন লজ্জাজনক পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করেছেন। সাথে লিখনের জন্য এমন একটা সুন্দর ব্যবসার উপায়ও বের করে দিলেন।’ উনার চোখ থেকে নীরবে বয়ে চলা নির্ঝরধারা মুক্তারদানার মতো চিকচিক করছে। লিখন তা আদুরে হাত দিয়ে মুছে দিল। আফসানা রুবাইয়াৎ একবার লিখনের মুখে স্নেহের হাত রেখে দৌড়ে চলে গেলেন বিছানো অবস্থায় থাকা জায়নামাজের উপর। সেজদায় লুটিয়ে পড়লেন। একটু দূর থেকে মায়ের এহেন পবিত্র ভালোবাসা উপলব্ধি করে লিখনও নির্বাক। ওর চোখ দু’টিও ছলছল করছে, হয়ত এখনই মহিমান্বিত স্রষ্টার জন্য প্রশংসা হয়ে নেমে আসবে অশ্রুকণা।

Share with Friends

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top