অনুপ্রেরণার গল্প:
একবিন্দু অনুপ্রেরণা
→ ডি এইচ শিশির
সায়াহ্ন ছুঁই ছুঁই মুহূর্ত। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। এরপর, তার সমস্ত ভালোবাসা ঢেলে দিয়ে আকাশময় ভরিয়ে দিয়েছে লাল আভার বন্যায়।
আকাশের স্বচ্ছ- গাঢ় নীল নীলাভের সাথে সন্ধার অস্তমিত সূর্যের ছড়ানো লাল আভার সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছে নামহীন একটি রং। ভালোবাসার রং যদি হয় লাল তবে নিশ্চয় কষ্টের রং হওয়ার কথা নীল। এই দুইয়ে মিলে যে রং তৈরি হয়েছে শিশির তার নাম দিয়েছে ‘নীলোবাসা’। এর অবশ্য একটি রহস্যাবৃত- সুপ্ত কারণ আছে, তা সময়পেলে পরে বলব।
গল্প
অপরাহ্ণের বিদায়বেলায় গোধুলীরাঙা এই সময়টি ইদানীং শিশিরের খুব প্রিয় হয়ে উঠেছে। কোন একটি কারণে ইদানীং তার মনটা ভীষণ বিষণ্ণ থাকে! তাই আম্মু বলেছে বাসার সামনে উঠানে থাকা ফুলের বাগানে বসে আসরের পর মুহূর্তটুকু প্রকৃতির অপরূপ রূপ- সৌন্দর্য উপভোগ করতে। এতে করে মন ভালো থাকবে, নতুন করে উদ্যমী হতে উৎসাহ যোগাবে। শুরু হবে একটি অনুপ্রেরণার গল্প।
শিশিরের আম্মু প্রচন্ডরকমের প্রকৃতি প্রেমী। তাই নিজ হাতে অতিযত্নে এই ফুলের বাগান তৈরি করেছেন। প্রতিটি গাছের চারাই লেগে আছে তার কোমল হাতের সন্তান সুলভ আদরযত্ন- ভালোবাসার প্রলেপ। তাই মায়ের কথামত কয়েকদিন ধরে শিশির প্রত্যহ বিকালে এখানে এসে বসে। রংবাহারি ফুল আর ছোট্টছোট্ট মুকুলের অস্ফুট পাপড়িকে ঘিরে রঙিন ছোট্ট পাখি, প্রজাপতি আর মৌমাছিদের ব্যস্ত উড়ে চলা তাকে মুগ্ধতা এনে দেয়।হালকা নরম বাতাসে ভেসে আসে তাদের গুনগুন গুঞ্জন। এই গুঞ্জনের মধ্যে সে কেমন জানি একটা অতি পরিচিত কিছুর আভাস পায়; কিন্তু কিসের আভাস তা ধরতে পারছেনা একদম ই।
গল্প | অনুপ্রেরণার গল্প
আম্মু এতক্ষণ ব্যলকনিতে দাঁড়িয়ে থেকে ছেলের কান্ড দেখছেন। উনার হাতে রয়েছে একটি চায়ের কাপ। গরম চায়ের কাপ থেকে একে বেঁকে উড়ে চলছে ধোয়া। তারপর মুহূর্তেই মিলিয়ে যাচ্ছে ।
বারান্দাজুড়ে চায়ের মিষ্টি গন্ধে মৌ মৌ করছে। সিলেটের খাঁটি চায়ের গন্ধে এটি। আম্মা দেখলেন, হঠাৎ কি যেন দেখে শিশির একদম চুপচাপ হয়ে গেলো। তারপর লতাকলমি আর সবুজ ঘাসের উপর হামাগুড়ি দিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে একটি ফুলের দিকে তাকিয়ে আছে।
আম্মা দূর থেকে স্পষ্ট দেখতে না পেলেও ছেলের কৌতূহলী চাহনি তার মনে একবিন্দু খুশি হয়ে আন্দোলিত হতে লাগলো। শিশির যেটিতে অবিচ্ছিন্ন দৃষ্টি ফেলে আছে সেটি একটি দোদুল্যমান হলুদ গোলাপ ফুল । সেটিতে একটি মৌমাছি মধু সংগ্রহণে ব্যস্ত । শিশির দেখল, একটু দূরে আরেকটি ফুলের উপর ছোট্টছোট্ট- কোমল পাখা মেলে একটি রংবাহারি প্রজাপতিও মধু সংগ্রহ করছে।
শিশিরের কেন যেন মনে হলো ওই প্রজাপতিটি মধু সংগ্রহ নয়; ফুলের কর্ণকুহরে মুখ নিয়ে হেসে হেসে গল্প করছে। আর ফুলও আনন্দিত হয়ে তার মধ্যে সযত্নে লালিত অমৃত মধু দিয়ে তাকে আপ্যায়ন করছে। তাই দেখে শিশিরের মন আনন্দে নেচে উঠল। বুকের মধ্যে বয়ে গেলো অনাবিল খুশির বাঁধ ভাঙ্গা স্রোত।
কিছুক্ষণ বাদে ও হঠাৎ খেয়াল করল প্রজাপতিটির সাথে একটি বাচ্চা প্রজাপতিও ফুলের উপর বসে পাখা মেলছে। একদমই ছোট্ট সেটি। মায়ের ডানার আড়ালে ঘুরাঘুরি করছে । কিন্তু শিশিরের মনে হলো বাচ্চাটি মধু মুখে নিয়ে উড়ে যাওয়ার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।
সে জীববিজ্ঞান পড়ছে চার বছর যাবৎ তাই জীবের বৈশিষ্ট্যাবলী বেশ ভালোই জানে। তার আরও মনে হলো, বাচ্চাটি সম্ভবত বারবার ব্যর্থ হচ্ছে নিয়মমতো মধু ক্যাচ করতে। কিন্তু মা তাকে আবার চেষ্টা করার প্রেরণা যোগাচ্ছে তার শুভ্র পাখাদুটো দিয়ে আদর করে দিয়ে। শিশির বেশ অনেক্ষণ ধরে দেখছিল এটি। অবশেষে বাচ্চা প্রজাপতিটি হয়ত মুখে মধু সমেত উড্ডয়নে সফল হয়েছে। তাই তারা ফুড়ুৎ করে উড়াল দিল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে হারিয়ে গেলো দৃষ্টি সীমার বাইরে।
শিশিরের মনে বারবার প্রজাপতি দুটির কার্যকলাপের স্থির চিত্র ভেসে উঠছে। আকস্মিক তার চাঁদ মুখে আঁধার নেমে এলো। মনে পড়ল তার মায়ের ক্লান্তিহীন ভাবে যুগিয়ে চলা উৎসাহ, উদ্দীপনা আর অনুপ্রেরণার কথা কথাগুলো। যা সে প্রতিনিয়ত এড়িয়ে চলেছে ভাগ্যের একটি নির্মম পরিহাসক ঘটনার পর থেকে। শিশির এবার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছিল। সবার প্রত্যাশা ছিল গোল্ডেন ‘এ +’ পাবে কিন্তু কোন একটা কারণে ‘এ+’ টি ও মিস করে ফেলেছে!
তাই ও নিজ সিদ্ধান্তে অটল যে মেডিকেল অথবা ভার্সিটি, কোনটির জন্যই সে লড়বে না। কিন্তু তার আম্মা কোন ভাবেই চাননি তার সন্তান জীবন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার আগেই পরাজয়ের গ্লানি তাকে আচ্ছন্ন করুক। তাই সবসময় তাকে ক্লান্তিহীনভাবে অনুপ্রাণিত করে আসছে।
কিন্তু শিশির তার কথায় কোন কর্ণপাত করছিলনা। আজ যখন এই অনুভূতিহীন পতঙ্গগুলির এই আচরণ অবলোকন করে তার মন পরিবর্তন হয়ে গেলো। আঁধারে অর্বকীর্ণ মুখে ফুটে উঠল একফোঁটা আলো।
ও ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগলো আম্মার দিকে। মনের ডায়েরীতে জমে থাকা অব্যক্ত কথাগুলো বলার প্রয়াসে । তার স্নায়ুতন্ত্রী জুড়ে একটিই কথা বারবার প্রতিধ্বনি হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে, ‘আম্মা আমি পারব, ইন্শাআল্লাহ্! আমাকে পারতেই হবে। দুনিয়াটা প্রতিযোগিতার কিন্তু ঠুনকো কিছুতে পিছপা হবার নয়’।