গল্প: ‘প্রতীক্ষা’ – ডি এইচ শিশির

প্রতীক্ষা

“প্রতীক্ষা”
ডি এইচ শিশির

এক,

একদিন অন্ধ ছেলেটি সমুদ্রের ধার দিয়ে হাঁটছিল। তার হাতে ছিলো একগুচ্ছ ফুল আর পিঠে ছোট্ট একটি থলে। ঊর্মিমালার কলতান আর তার কণ্ঠ নিঃসৃত মনোমুগ্ধকর সুরে আবৃত কথাগুলো ভেসে ভেসে মিশে যাচ্ছিল শীতল জলরাশির স্পর্শ নিয়ে আসা মৃদু বাতাসে।

দুই,

সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলের এদিকটাতে বসবাস ছিলো নিয়ন্ঝু নামক এক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর। তারা আধুনিক সভ্যতা থেকে অনেকটা পিছিয়ে আছে। কিন্তু আধুনিকতার প্রসারণে সভ্যতার আলো ধীরেধীরে প্রবেশ করতে শুরু করেছে তাদের মধ্যেও। আশেপাশের অন্যান্য আদিবাসীরা সবাই বহু ইশ্বরে বিশ্বাসী হলেও এই গোত্রটি ছিলো একেশ্বরে বিশ্বাসী। মানুষ স্বভাবতই কোনো না কোনো দৃশ্যমান বা অদৃশ্য মহাশক্তির নিকট মাথানত করার মাধ্যমে নিজ আত্মাকে অপার্থিব প্রশান্তির স্পর্শ দিতে পছন্দ করে। এই নিয়ন্ঝুরাও তার ব্যতিক্রম না। পাথরে লিপিবদ্ধ ধর্মগ্রন্থ অনুসরণ করে যুগযুগ ধরে তারা ধর্মিয় সংস্কৃতি পালন করে আসছে। শুধু তাই নয় তারা পরকালেও বিশ্বাস করে। তারা মনে করে ইবাদতের মাধ্যমে স্রষ্টাকে খুশি করার মধ্য দিয়ে তারা পরকালে সীমাহীন শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি এবং অনন্তকালের স্থায়ী শান্তিসমৃদ্ধ স্বর্গ উপহার পেতে পারে। তারা অপেক্ষারত, তাদের ধর্মগ্রন্থে লেখা আছে যে, যিনি তাদের স্রষ্টা প্রদত্ত পথ প্রদর্শক ছিলেন তারই মতো আরেকজন পথপ্রদর্শক দুনিয়াতে আসবেন এবং শেষবারের মতো । আর তিনি এসে তাদেরকে স্রষ্টার দিকে আহ্বান করবেন অথবা তার বার্তা পৌঁছে দিবেন। এই আহ্বানে যাদের সাড়া দেওয়ার সৌভাগ্য হবে তারাই হবে প্রথমসারীর মুক্তিলাভকারী।

তিন,

ছেলেটা দৃষ্টিহীন ঠিকই কিন্তু জন্মান্ধ নয়। সে ছিলো একজন তরুণ ডাক্তার। ইউত্রোনিকফা মেডিকেল ইউনিভার্সিটি থেকে গোল্ড মেডেল প্রাপ্ত ছাত্র সে। সে স্রষ্টায় অবিশ্বাসী একটা পরিবারে জন্মগ্রহণের সুত্রে নিজেও সেই বিশ্বাসে বেড়ে উঠেছে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নের সময় শরীরের বিভিন্ন অংগপ্রত্যঙ্গ নিয়ে গবেষণা কালে মানব শরীরের অত্যন্ত জটিল সত্ত্বেও নিঁখুত- সুক্ষ্ম ডিজাইন দেখে নিজের বিশ্বাসের উপর অটল থাকতে পারল না। ও কোনোভাবেই মেনে নিতে পারলনা যে, চারিদিকে এতো এতো সুশৃঙ্খল সৃষ্টির পিছনে একজন অতি সুক্ষ্মদর্শী, মহাপ্রজ্ঞাময় ডিজাইনার থাকবেন না। এরপর, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়াশুনা এবং একসময় আল্লাহর রহমতপ্রাপ্ত হয়ে ইসলামকেই সঠিক ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেবার মাধ্যমে মুসলিম নামক আলোকপথের অভিযাত্রীদের দলে নাম লেখানো। তারপর, ধর্ম নিয়ে বিশদ গবেষণাকালে সে উদ্ভাবন করল যে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এমন কিছু কিছু ধর্ম বিশ্বাসী জাতী- গোষ্ঠী আছে যারা মূর্তিপূজা বাদ দিয়ে একেশ্বরে বিশ্বাস করে। সবচাইতে বড় কথা হলো তাদের সংস্কৃতি পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে ইসলাম সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে যে সমস্ত আদী ধর্মের সত্যায়ন এবং প্রতিনিধিত্ব করছে তাঁদের বৈশিষ্ট্য এসমস্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান। তখন থেকে সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় যেভাবেই হোক সে এদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেবে। বিভিন্ন তথ্যের মাধ্যমে ওর মনে বিশ্বাস জন্মেছে যে এরাও এই সত্যায়নের জন্য অপেক্ষমাণ। সে দায়িত্ব অনুভব করে এসমস্ত মানুষের কাছে ইসলামের সুমহান দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার। সবকিছুই করছিলো পরিকল্পনা অনুযায়ী কিন্তু মাঝপথে এসে একটা দুর্ঘটনায় সে দৃষ্টিশক্তির তীক্ষ্ণতা হারায় এবং তার সকল প্রচেষ্টাও থমকে যায় সেখানেই। তবুও, উদ্দেশ্য যদি সৎ হয় আল্লাহ তার সহায় হন এই কথার উপর বিশ্বাস রেখেই অন্ধত্ব সত্ত্বেও থমকে যাওয়া দাওয়াতি কাফেলাকে সে আবার সচল করে তোলে। নও মুসলিম কিন্তু ঈমানী শক্তিতে সে ছিলো অদম্য, উজ্জীবিত।

চার,

সায়াহ্নে সমুদ্রের গাঢ় নীলবর্ণের পানি আর তীরে ভেজা বালির উপর সূর্যরশ্মি পড়ে অদ্ভুত সুন্দর নিয়ন আভা বিকিরণ করছে। সেই ঝলমলে আলোর মাঝ দিয়ে সুদূর প্রসারিত দৃষ্টি রেখে পথ চলছে একজন পথিক। সে জানেনা তার দাওয়াত ঐ মানুষগুলো গ্রহণ করবে কি না। তবুও সে দায়িত্বপালনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাকে তো দাওয়াত পৌঁছাতেই হবে। তার বিশ্বাস, দুর্গম হলেও সে যে পথে হেঁটে চলেছে সেপথের শেষ প্রান্তেই রয়েছে জান্নাত। তাই সে অল্পঅল্প করে দুর্গম সেই পথ অতিক্রম করে চলেছে আলোর প্রতিক্ষায় উন্মুখ হয়ে থাকা জনগোষ্ঠী কে আলোর দিশা দিতে।
যুগযুগ ধরে জমে থাকা আঁধার কেটে ফুঁটে উঠবে নতুন আলোর ভোর, সেই প্রত্যাশায়।

Share with Friends

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top