আত্মার বোবা কান্না – ডি এইচ শিশির

আত্মার বোবা কান্না “বাবা আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে আমাকে একটু খেতে দেবে..?” আমি বললাম । “যখন এখানে জীবন বাঁচানোই দাই হয়ে পড়েছে তখন তোমাকে খেতে দেব কোথা থেকে..? ঐ মুসা মিঞা জলদি হাত চালাও। যেভাবেই হক ভোর হবার আগেই নাউ ডাঙ্গাই ভিড়াইতে হবে..নচেৎ যদি একবার ওই মানুষ রূপী হায়েনা গুলোর নজরে পড়ে যায় তবে এই মাঝ সাগরের বু্কেই চিরকালের জন্য আমাদের সলিলসমাধি করে দিবে!” বাবা বললেন । বাবার কথাগুলো শুনে মায়ের মলিন মুখটা আরো বেশি মলিন হয়ে গেলো..!! আর হবেনাইবা কেনো..? আজ তিন দিন যাবৎ আমরা পানির উপরে যাযাবরের মতো ভেসে চলেছি। নাফ নদীর এই গাড় নীল পানিতে আমি এর আগেও বহুবার ভেসেছি আমার পরিবারের সাথে। তখন আমরা আসতাম ছুটির দিনে একটু আনন্দের খোঁজে আর আল্লাহ তায়ালার এই অপরূপ সৃষ্টি সৌন্দর্য অবলোকন করতে.. কিন্তু আজ ভাসছি জীবন বাচাঁবার তাগিদে! একটু খানি নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় এখানে ওখানে ঘুরছি তৃষ্ণার্ত চাতক পাখির মতো। সস্থির নিঃশ্বাসটুকু ফেলার প্রয়াসটাও আজ আমাদের কাছে আকাশ কুশুম কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়! ও হ্যাঁ বলাই হয়নি আমি শিশির, বাবার দেওয়া আরেকটা নাম অবশ্য মিয়ং.. এই নামেই উনি আদর করে ডাকেন আমাকে। আমরা রোহিঙ্গা, মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশের মুরং নামক শহরে আমার বাড়ী। যদিও এখন সেখানে আমার বাড়ীর শেষ অস্তিত্বটুকুও নেই হয়তো..!! আমার বাবা পেশাই একজন ডাক্তার । তিনি নিজের হাতে যে, কতো মানুষের সেবা করেছেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তার মধ্যেতো বাদ যায়নি ঐ নিষ্ঠুর রাখাইন বৈদ্ধরাও। এতো খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, যখন তাদের বিপদের দিনে বাবা গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে চলে যেতেন তাদের পাশে দাড়াতে! সারারাত জেঁগে যুদ্ধ বিধস্ত রাখাইন বৈদ্ধদের সেবা শুশ্রুষা করতেন.. কিন্তু তারা আজ সেই কষ্টের এ কী প্রতিদান দিলো..? আজ থেকে মাত্র চারদিন আগের কথা, সন্ধার দিকে কিসের যেন একটা চাপা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে.. আজ নাকি কিছু একটা হতে চলেছে..এমনটাই বলছিলো সবাই । বাবা আবার বললেন- “আমি, আমার জীবনে কখনো কারো কোনো ক্ষতি করিনি তাই এতো ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই তোমরা নিশ্চিন্ত থাকো আল্লাহ ভরসা ।” আব্বুর কথার উপরে আর কেউ কোনো কথা বললো না সেদিন রাত দুইটার দিকে প্রচন্ড শব্দে জেঁগে উঠি। চোখ মুছতে মুছতে বাইরে এসে দেখি, আব্বু-আম্মুরা অনেক আগেই জেঁগে উঠেছে। আমার চাচাদের ঘরে আগুন জ্বলছে! দাও দাও করা আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে..। আম্মু কিছু চিড়ে গুড়- মুড়ি বেঁধে নিয়ে কোথাই যেনো যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। চারিদিক থেকে চিৎকার চেঁচামেচি আর কান্নার আওয়াজে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠছে । হঠাৎ করেই একদল রাখাইন সৈন্য ঢুকে পড়লো আমাদের বাড়ীতে। তাই দেখে বাবা আমাদের নিয়ে একটা ঝোঁপের আড়ালে গিয়ে লুকালেন । আর তখনি তারা আমাদের চোখের সামনে প্রদর্শন করলো তাদের বর্বরতা আর নিষ্ঠুরতার বিভৎস চিত্র! আমাদের চোখের সামনেই ওরা পৈশাচিক ভাবে খুন করলো আমার চাচা-চাচিদের । তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি আমার একমাত্র চাচাতো ভাই হাসানও; যাকে ওরা ভাঙ্গা মদের বোতল দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে অত্যান্ত… ভাবে খুন করছিলো! এই দৃশ্য দেখে আমার বাবা-মা ছটফট করতে লাগলো আর ডুঁকরে কেঁদে উঠলাম আমি নিজেও। বাবা আমার মুখটাচেপে ধরে বুকে জড়িয়ে নিলেন । আমাদের চোখের সামনেই এতো কিছু ঘটালো ওরা; কিন্তু আমরা আমাদের স্বজনদের হৃদয়ের বোবা কান্না ছাড়া আর কিছুই উপহার দিতে পারলামনা। বাবা আমাদেরকে নিয়ে চলে আসতে চায়লেন ওখান থেকে। আমি ওনাকে জোর করে ওখান থেকে পাঠিয়ে দিয়ে পরাহত নয়নে তাকিয়ে আছি আমার মৃত ভাইয়ের নিষ্পাপ চেহারার দিকে। আমার দু’চোখ বেয়ে ঝরে পড়ছে ব্যার্থতার নির্ঝর নোনা বৃষ্টি! একটু খানি আগেও যে ছিলো চঞ্চল, হুটো-পুঁটি করে বেড়ানো একটা হাসি-খুশি। আর সারা বাড়ী মাতিয়ে রাখা দুষ্টু বালক এক মুহূর্তেই আমার সামনে পড়ে আছে তার অতি নিস্তব্ধ নিথর দেহ। এই একটা কালো রাত সব কিছুই যেনো স্বপ্নের মতো করে শেষ করে দিয়ে যাচ্ছে! এক মুহূর্তের ব্যবধানে যেটা দেখলাম তাতে আমার সব কষ্টের সীমারেখা ছাড়িয়ে গেলো। আমার খেলার সাথি, আমার বন্ধু সামিয়াকে ওরা আট-দশ জন মিলে পাশবিক অত্যাচার করছে..!! আমার বোনের অসহায় চিৎকারে আকাশ-বাতাস এমনকি আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠছে কিন্তু তার এই করুন আর্তনাদে একটুও কাঁপছেনা ওই মানূষরুপি জানোয়ার গুলোর বুক..। তার কষ্টাত্বক মিনতি একটুও আঘাত হানছেনা তাদের হৃদয়ে । তারা কেউ কেউ আবার তার আর্তনাদের ব্যঙ্গ করে আনন্দ উৎসব করছে আর মজা নিচ্ছে..!! আমি আর পারলামনা সহ্য করতে; আমার সামনে আমার বোনকে হায়েনারা চিঁড়ে চিঁড়ে খাবে আর আমি কিছুই করতে পারবোনা..? যখনি আমি ওদের সামনে গিয়ে দাড়াব, তখনি খেয়াল করলাম কেউ একজন আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে.. পরে খেয়াল করে দেখলাম ঘাঁটের মাঝি চাচা, উনার ঘর বাড়ীও নাকি ওরা জ্বালীয়ে দিয়েছে। তারসাথে ঘাঁটে এসে দেখলাম নৌকা রেডি সবাই মিলে নাফ নদী দিয়ে বঙ্গবসাগর হয়ে বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন দ্বিপে গিয়ে উঠবো। সব ঠিক- ঠাক ছিলো যখন দুই দিন ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমাদের পাশ্ববর্তি মুসলিম ভাইয়েদের দেশে গিয়ে পৌঁছাব তখন মাঝ সাগরে তাদের জল সিমানার প্রারাম্ভে এসে আমাদের আটকে দিলো আমাদেরিই ধর্মের ভাই কোস্ট গার্ডরা। আমাদের শত আকুতি-মিনতি তাদের কর্ণ কূহর দিয়ে হৃদয় স্পর্শ করতে পারলোনা! আমাদের চোখের পানিতে তারা একটুও বিচলিত নয়। বরং তারা বিচলিত আমাদের তাড়িয়ে দেওয়ার চিন্তাই। আমাদেরকে জোর করেই আবার পাঠিয়ে দেওয়া হলো মায়ানমার অভিমুখে। আমাদের একবুক আশা এভাবেই এক সাগর নিরাশায় পরিণত হলো। আজ দুই দিন ধরে যে আশাটুকু ঘিরে কল্পনা করছিলাম এখটু খানি নিরাপদ আশ্রয়ের- জিবন বাঁচাতে দু’মুঠো অন্ন নয় অন্তত একটু খানি অতিথি সুলভ আচরণ! মাথা গোজার ঠায় না হয় নাই পেলাম, অন্তত প্রান ভরে নিঃশ্বাসটুকুতো নিতে পরবো! কিন্তু যেটিভেবে এই নিরাহার দেহে শক্তি সঞ্চালন করছিলাম তা এক মুহূর্তেই শিথিল হয়ে এলো! বাচাঁর প্রবল আশাটুকুও হারাতে বসেছি। কিন্তু ও আমার বাঙ্গালী ভায়েরা এই কি ছিলো আমাদের ধর্মিয় বিধান? এই কি ছিলো রাসুল (সা.) এর হিজরতের শিক্ষা..? আজ যখন শান্তিতে নোবেল পাওয়া সুচি তার সর্বচ্ছ অশান্তির কার্যলাপ করে যাচ্ছে। নির্বিচারে হত্যা করছে তোমার আমার স্বজাতী মুসলিমদের; তখন তোমরা পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছ..? আমাদের অসহায় চিৎকার কান্না আহাজারি কী তোমাদের হৃদয় একটুও দাঁগ কাঁটছেনা..? ও পৃথিবীর মুসলিম ভাইয়েরা তোমরা কি ভুলে গেছো আল্লাহর বিধান কি বলছে..? আল- কোরআনেতো বলা হচ্ছে –‘যখন তোমাদের মধ্য হতে কোনো মুসলিম বিনা দোষে বাতিলের হাতে আঘাত প্রাপ্ত হলো তখন যেনো সমস্ত মুসলিমের দেহে আঘাত করা হলো!’ তাহলে আজোও কি তোমরা চুপ করে থাকবে..? এটাতো ফরজে আইন হয়ে যায় তোমাদের উপর। নাকি এখনো তোমরা সত্য থেকে শত ক্রোশ দূরে অবস্থান করছো..? যদি আজ সমগ্র মুসলিমরা একযোগে একবার আল্লাহর নাম নিয়ে বলতো “ধরো”.. তাহলে আজ সুচি কেন কোনো বৈদ্ধদের সাহস হতোনা আমাদের শরীরে এতোটুকু আঘাত করে! যাকগে, সে সব কথা বলে আর কি করব..? আমার বৃথা চিৎকার নদীর ওপার থেকে প্রতিধ্বনী হয়ে ফিরে এলো। সবাই মলিন মুখে বসে আছি পালতোলা নৌকাই। আর নৌকা হেলে দুলে আপন গতীতে ভেসে চলেছে স্রোতের অনুকুলে..!! মা তার আঁচলে বাঁধা কিছু শুকনা চিড়ে এগিয়ে দিলো আমার দিকে..আর বাবা সহ সবাই ছল-ছলে চোখে এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে । আমরা স্রোতের টানে আবার মায়ানমারেই ফিরে এসেছি.. আর ভেসে চলেছি গন্তব্যহীন পথের পানে ।হায়েনার মুখথেকে বাঁচতে জীবন হাতে নিয়ে ছুটছিলাম একটু খানি নিরাপদ আশ্রয়ের আশায়..কিন্তু বাঘের তাড়া খেয়ে এখন কুমিরের পেটে যাওয়ার অনাকাঙ্খিত অফেক্ষা……
Share with Friends

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top