ভালোবাসার গল্প | ভাই বোনের ভালোবাসার গল্প | হৃদ স্পন্দন | ডি এইচ শিশির

Dh Shishir

ভাই বোনের ভালোবাসার অন্যরকম হৃদয়স্পর্শী গল্প: হৃদস্পন্দন

লেখক: ডি এইচ শিশির
ইংরেজি বিভাগ, শাবিপ্রবি

‘ভাইয়ু, ও ভাইয়ু ওঠ। আজ আমার স্কুলে দিয়ে আসবেনা? দেখ আমার স্কুলের টাইম কিন্তু পার হয়ে যাচ্ছে ।‘

নিশুর ডাকে ঘুম ভাঙলো । আরে তাইতো জানালার ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যের আলোক্ছটার মৃদু তেজ দেখে বুঝতে পারলাম আজ উঠতে বেশ দেরি করে ফেলেছি । পাশে তাকিয়ে দেখি নিশুর পুতুলটা উল্টো হয়ে পড়ে আছে বেডের এক কোণে । তার মানে পুচকেটা আজকেও আমার আগে জেগে উঠেছে ।

উঠে টাওয়ালটা কাঁধে ফেলে ওয়াস রুমে ঢুকলাম তারপর মুখে পানি দিয়ে ফ্রেস হতে যাব ঠিক তখন যা দেখলাম তাতে হাসতে হাসতে আমার পেট ফেঁটে কুমড়াপটাশ হবার উপক্রম হলো, আমার কপালে একটা কালো টিপ, আর চোখে মুখে পাঁচ-সাত প্রকার রঙ দিয়ে রং-বেরং এর প্রলেপন করা হয়েছে। আবার ঠোঁটে দেখছি হালকা গোলাপি রঙ্গের লিপস্টিক দেওয়া।

সব মিলিয়ে রঙ মেখে সঙ সেজে আয়নার সামনে দাড়িয়ে আছি আমি । বুঝতে বাকি নেই আমার হার্ট, আমার হৃদস্পন্দন, একমাত্র ছোটবোন নিশুর কারসাজি এটা । গত পরশুদিন বায়না করে যে মেকাপ বক্সটা ও নিয়েছিলো তার প্রারাম্ভিক প্রাকটিসটা আমাকে দিয়েই সেরেছে ।
ও মাঝে-মাঝেই এমন সব অদ্ভুত কাণ্ড করে বসে যা দেখলে গোমড়া মুখো প্যাঁচাও হাসতে হাসতে সেন্সলেস হয়ে যাবে । আমার অবস্থাতো যায় যায়! অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আয়নার ভিতরে থাকা মানুষটাও বেশ মজা নিচ্ছে আমার এমন চেহারা দেখে ।

হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে এসে নিশুর জন্য নাস্তা রেডি করে প্লেট হাতে ওকে খুঁজতে-খুঁজতে বাসার সামনের বাগানে চলে এসেছি । এসে দেখি বোনটি আমার কার সাথে জানি ছোট ছোট শব্দে কথা বলছে । অনেকটা কৌতূহল  নিয়ে সামনে গিয়ে দেখি আমার প্রিয় নীল গোলাপ গাছের ডালে বসে আছে ছোট্ট একটা  প্রজাপতি, আর তার সাথে কথা বলছে নিশু । অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম তাদের কাণ্ড- কারখানা । মনে হচ্ছে নিশুর কথার সাথে সাথে ডানা নেড়ে প্রতিটা কথার সায় দিচ্ছে প্রজাপতির ছানাটি ।

‘নিশু, আপু কি করছো..?‘

‘ভাইয়ু এসেছো? ‘ ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখে দুষ্টু মেয়েটি খিঁল খিঁলিয়ে হাসতে লাগলো। ও যখন হাসে তখন ওর চোখের পাপড়িগুলো দাঁড়িয়ে যায়, নিষ্পাপ মুখে এক অন্যরকম সৌন্দর্য ফুঁটে ওঠে । তখন আমার বুকের অভ্যন্তরে স্পর্শ করে এক অন্যরকম ভালোলাগার ঝিলিক ।

‘তুমি আমার মুখে এমন ভাবে আঁকি-বুকি করেছো কেন, হুমম?‘ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বেশ অভিমানি সুরে বললাম ।
‘ও ভাইয়ু তুমি রাগ করেছো?‘
কিছু বললামনা আমি। মুহূর্তেই ধুপ করে নিভে গেলো হাসি । মুখটা আঁধারে ঢেকে গেলো ।

‘ভাইয়ু তুমি কথা বলছোনা কেন? তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসনা তুমি যখন বাসায় থাকনা তখন আমি একলা থাকি, ফুলগাছ, প্রজাপতি আর ঐ দোয়েলপাখিটা ছাড়া আমার আর কোন বন্ধু নেই । একলা বাসায় আমার একদম ভালো লাগেনা । সারাক্ষণ আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করি । ক্লাসের সব বান্ধবীদের বাড়ী অনেক মানুষ, ওরা সবাই অনেক মজা করে আর আমি..? আমার কেউ নেই, তুমিও কথা বলছনা, ঠিক আছে মনে থাকে যেন তাহলে আমিও পাপা আর আম্মুর মত লুকিয়ে থাকব । আমিও দূর আকাশের তাঁরা হয়ে তোমাকে দেখব কিন্তু তুমি আমাকে দেখতে পারবেনা । এই বলে বোনটি আমার ঠোঁট ফুলিয়ে শব্দ করে ডুকরে কেঁদে উঠলো । তার কান্না দেখে আমিও কেঁদে ফেললাম । বোনটি আমার কান্না দেখে চিলের মত ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো । হাও-মাও করে দু’ভাই-বোন কাঁদতে লাগলাম দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে । নিশু আমার কান্না দেখে বড় বোনের মত করে নিজের কান্না থামিয়ে তার ছোট্ট ছোট্ট হাত দুটি দিয়ে আমার চোখের পানি মুছে দিলো । আমাকে চুমু দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরলো । আর বলতে লাগলো
‘ভাইয়া আমি কিচ্ছু চাইনা, শুধু তোমাকে চাই । তোমাকে ছাড়া যে আমি বাঁচব না । ভাইয়ু প্লীজ একবার হাসো প্লীজ ।‘ গাল ফুলিয়ে তার কথা বলার স্টাইল দেখে আমি কাঁদতে কাঁদতেও জল চোখে নিয়েই হেসে ফেললাম । কান্না হাসিতে একাকার হয়ে গেলো আমাদের ফুলের বাগানটি ।

আমি ওর মুখে নাস্তা তুলে দিতে দিতে জানতে চাইলাম ।
‘আচ্ছা নিশু বল এবার তুই আসলেই কী চাস? ‘
‘ ও অন্যদিকে ফিরে বললো । তোমাকে মেকাপ করলে মানায়না, আর আমি বিউটিশিয়ান হতে চাই এজন্য এক্সারসাইজ করার জন্য একজন মানুষ চাই ।‘ আরে দুষ্টু মেয়ে! ওতো একদম পাকা বুড়ির মত করে কথা বললো । কিন্তু..

আমি নিশুর চুলের বিউনি করে দিচ্ছি । নিশু খেলছে আর গল্প করছে কিন্তু আমার মনে তখন অন্য চিন্তা । খুব ছোট বেলা এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আমাদের বাবা মা হারা করেছে । এখন ও আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন । আজ অবুঝ মেয়েটা যা চাচ্ছে তা যদি হয়ে যায় ওর জন্য দুঃখের কারণ তবে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না কখনো!

ভাবছি, ভাবনা যেন কুলহীন । কোন সিদ্ধান্তই মনপুত  হচ্ছেনা ।

দুই.

নিশুর স্কুল ব্যাগটা আমার এক হাতে আর অন্যহাতের কড়ে আঙ্গুল ধরে ও বাঁদরের মত লাফাতে লাফাতে পথ চলছে । ওর মত চঞ্চলা মেয়ে আমি দ্বিতীয়টা দেখিনি । মাঝপথে হঠাৎ করেই ও থেমে গেলো তারপর আমার দিকে তাকিয়ে আদুরে গলাতে বললো,

– ‘ভাইয়ু, ও ভাইয়ু একটু নিচু হওনা প্লিজ ।’ অবাক হয়ে বললাম,

– কেন কি হয়েছে? ও চোখ পাকিয়ে বললো,
– এত বেশি কথা বল কেন হুমম? যা বলছি তাই কর । কি ইচড়ে পাকা মেয়েরে বাবা! একটু রাগি মুড নিয়ে বললাম
– ঐ তোমাকে ম্যামরা কিভাবে বড়দের সাথে কথা বলতে হয় তা শেখায়নি হুমম? বলতে দেরি উত্তর করতে দেরি নয়,
– তোমাকে কি ম্যামরা শেখাইনি কিভাবে ছোটদের সাথে কথা বলতে হয়? তুমি কি জান না ছোটরা হয় ফুলের মত তাদের বকতে হয় না?’ বুঝলাম ওর সাথে কথায় পারবনা তাই তাড়াতাড়ি হার মেনে নিলাম,

– হয়েছে হয়েছে থাম এবার । পাকনা বুড়ি । এই যে নিচু হলাম এবার কি বলবি বল । পাকনা বুড়ি বলাতে কিছুক্ষণ খিলখিল করে হেসে নিলো তারপর বললো

– চোখ বন্ধ করো । করলাম । তারপর ও কাউন্ট করা শুরু করলো,

– পাপ্পি নং ওয়ান, পাপ্পি নং টু….ফাইব…… নাইন…..পাপ্পি নং টেন । এবার আমাকে কোলে নাও । তারপর ঐ দোকানটিতে চল । দোকানে নামিয়ে দিতেই একগাদা চকলেট কিনে আমার হাতে দিলো, তারপর বললো পার্সটা দাও । দিলাম । ও নিজেই বিল দিয়ে এসে এবার কোমরে হাত দিয়ে বিশেষ ভঙ্গিমায় বললো,

– হাবার মত চেয়ে আছ কেন হুমম কিছুই বুঝনি তাই না? আমি ইশারাই বললাম ‘হু’ প্রবলেম নাই এবার বুঝিয়ে দিচ্ছি । তার আগে বলতো এক্সামের সময় তুমি ম্যাথে কত নাম্বার পেতে?

– উহ্ নিশু কিসের মধ্যে কি? হচ্ছিলো অন্য একটা কথা তার মধ্যে আবার ম্যাথ কেন?
– তোমাকে না বলতে বলেছি?
– এ (+)
– কিন্তু আমার তো মনে হয় ফেইল করেছিলে ।
– কেন?
– পরে বলব । আগে হিসেবটা শুনে নাও । তোমার পার্স থেকে যে টাকা নিয়েছি তার জন্য সাতটা পাপ্পি । একটা গিফ্ট আর বাকি দুইটা ভুল করে বেশি দিয়ে ফেলেছি । এখন যেহেতু ভুল করেই ফেলেছি! ব্যাপার না সিস্টেম জানা আছে, তুমি ঐ যে গাছের নিচে একটা মেয়ে দেখতে পারছো ‘ইশারাই দেখালো’ ‘হুমম পারছি’ আমি উত্তর দিলাম ।

– গুড! তাহলে এবার যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ, করে অতিরিক্ত চকলেটগুলো উনাকে দিয়ে এসো ।
ওর কথা শুনে কেমন একটা অবাক, নির্বাক, ভয়ার্ত দৃষ্টিতে একবার ঐ মেয়েটা আরেকবার নিশুর দিকে তাকাচ্ছি । তাই দেখে নিশু বললো,

– তোমাকে দিয়ে কিছুই হবে না এজন্যই তো বলেছিলাম যে তুমি ম্যাথে ফেইল করেছো । এই বলে এক মুঠো চকলেট নিজের হাতে নিয়ে বললো,

– এগুলো তোমার । আর তোমার হাতের গুলো উনাকে দিয়ে এসো । খবরদার একটাও চুরি করবা না । আল্লাহগো এমন বোন কেন দিলে? একে নিয়ে কোথাও গেলেতো মাইর একটাও নিচে পড়ার সম্ভাবনা -১০ % । বললাম

– নিশু, ভয় লাগছে। যদি থাপ্পড় মারে?
– মারবে কেন? আমিতো আছি ।
– তারপরেও…
– ঐ তুমি না ছেলে? যাও আগে, না গেলে আমি আর তোমার সাথে কথাই বলবনা । আল্লাহ কী বিপাকে ফেললে এদিকে বোন অপর দিকে অচেনা সুন্দরী ।

একপা একপা করে হাটছি আর বন্ধুদের কাছে শোনা সারা জীবনের গল্প গুলো মনে পড়ছে । কে কয়টা চড়-থাপ্পড় খেয়েছে তাও বাদ যাচ্ছে না । পিছনে তাকিয়ে দেখি নিশু হাসছে আর আড় চোখে তাকিয়ে দেখি সামনের  সুন্দরী ফোন টিপছে আর মিটিমিটি হাসছে । আর আমার মনে ভাসছে এই হাসির যায়গাতে রাগি মুখখানি কেমন হতে পারে তার ছাঁয়ালিপি ।

মনে মনে দোআ পড়ছি আর এগুচ্ছি । অবশেষে উনার সামনে গিয়ে দাড়ালাম । এক নজরে যতটুকু দেখলাম তাতে বলা যায় ‘মাশাআল্লাহ’ অনিন্দ্য সুন্দরী । চোখ ফেরাতে একটু দেরি হলো তাই চোখ পাকিয়ে বললো,

– এই যে, কখনো মেয়ে মানুষ দেখেননি নাকি হুমম?

ওয়াও! কি সুন্দর কন্ঠ! কিন্তু সেই কন্ঠে এমন বিদঘুটে টাইপের ভৎসনা বড়ই বেমানান, তাই তড়িঘড়ি করে চকলেটগুলো তারদিকে বাড়িয়ে ধরলাম, তা দেখে তিনি বললেন,
– কী ব্যাপার আমাকে দেখে কি আপনার পিচ্চি মনে হচ্ছে যে চকলেট দিচ্ছেন?

আমি বেশ লজ্জিত হলাম । ভাবলাম তাইতো উনিতো পিচ্চি নয় তাহলে আমি তাকে চকলেট কেন দিলাম? ও হ্যাঁ মনে পড়েছে, নিশু দিতে বলেছে তাই দিতে চেয়েছি । তো উনাকে কথাটা বলব বলে ঘুরে দাঁড়িয়েছি তখনি দেখলাম অদ্ভুত কান্ড! নিশু ঐ মেয়েটার সাথে ঝগড়া করছে,

– কি যুগ পড়েছে! মানুষের উপকার করলেও দোষ । ভাবলাম আপনি একা একা দাঁড়িয়ে আছেন কিছু চকলেট দিলে বেশ সময়টা কেটে যাবে । কিন্তু না, আপনি আমার ভাইয়ুকেই বকছেন? আপনার সাহস তো কম নয়!

আমি সব তালগোল পাকাতে বসেছি তাই তাড়াতাড়ি বললাম,

– নিশু চুপ কর বড়দের সাথে এভাবে কথা বলতে হয় না ।

ওরে বাবা ও উল্টো আমাকেই থামতে বললো তারপর আবার মেয়েটাকে ধরলো,

– জানি যে, আমার ভাইয়ু একটু হাবা । তাই বলে তাকে আপনি বকবেন? আমি কি মরে গেছি হুমম?

আরে এই নিশু আমার পক্ষে, না বিপক্ষে কিছুই বুঝতে পারছিনা। ইচ্ছে মত আদাজল খেয়ে পঁচাচ্ছে । তবুও আর যাইহোক তার কথা শুনে মেয়েটা বেশ লজ্জিত হলো এবং নিশুকে কোলে নিয়ে বললো,

– সরি্ বাবু! আমার ভুল হয়েছে একজন বোকা-সোকা মানুষকে এভাবে বলাটা আমার একদম ঠিক হয়নি । মাফ করে দাও প্লিজ ।

কি! এই মেয়েটাও আমাকে বোকা বললো? উহ্ আমিতো সত্যিই বোকা! কি হচ্ছে আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছিনা । কিন্তু মাথাই বাজ পড়লো নিশুর পরবর্তী কথা শুনে । ও বললো,

– আচ্ছা মাফ করতে পারি একটা শর্তে । আমার ভাইয়ুর সাথে আপনাকে বন্ধুত্ব করতে হবে, তাকে আমার মত চালাক বানাতে হবে । রাজি?

– হুমম যদিওবা একটু কষ্ট হবে । আফ্টার অল একটা গাঁধাকে মানুষ বানাতে হবে বলে কথা । তবে তোমার জন্য রাজী ।

কী আমি গাঁধা! ও আল্লাহ্ এসব কি শুনছি? কিছু বলতেও পারছিনা কারণ এমন পরিস্থিতিতে কি বলতে হয় তাও জানি না । নিশু কানে কানে বললো

– কেমন দিলাম উনাকে?

এই বলে হাতটা এগিয়ে দিলো উইস করার জন্য । আমিতো নিজের বাশ গুনছি তবুও আবার বোকা না বলে এই ভেবে হাবা-গোবা চেহারাযুক্ত অবস্থায় হাত মেলাতে চাইলাম । তবুও কী জানি ভেবে আবার ফিরিয়ে দিলাম। উনি মনে হয় একটু বিব্রত হলেন। যাইহোক,  তারপর নিশু মেয়েটাকে আমার ফোন নং দিলো আর বলেলো ঘন্টায় ঘন্টায় খবর না নিলে তার খবর ও নিজেই তৈরী করবে ।

বাসার ব্যালকনিতে বসে বসে ভাবছি দিনের ঘটে যাওয়া সব ঘটনার সারাংশ । একবার ভাবছি নিশু ছোট হলেও মাথায় কত্ত বুদ্ধি! মেয়েটাকে এমনভাবে ঘোল খাওয়ালো! আবার ভাবনাও চলে আসছে তাইত ও তো আমার কাঁধেও একটা বান্দরীর অধিকার চাপিয়ে দিলো । এসব ভাবছি ঠিক তখনি নিশু ফোন নিয়ে প্রবেশ করলো ‘ভাইয়ু দেখতো কে ফোন করলো‘ স্কিনে তাকিয়ে দেখি একটা অচেনা নং। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো…

তিন.

ফোনের ওপার থেকে মেয়েটি বললো,

– এত তাড়াতাড়ি ভুললে চলবে মিঃ হাবা?
হাবা! আমি হাবা? মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো, রেঁগে- মেগে বললাম

– ফাইজলামি করার আর যায়গা পাননা তাই না? ঐ আপনি কে, হ্যাঁ?
– আমি
– আমি কে?
– আপনি হাবা ।
– উহু! আপনাকে আমি সামনে পেলে..
– কি করবেন?
– কিছু না । আপনি আমার নং কোথায় পেলেন?
– ভুলে গেলেন? ঐ যে তখন কিউট মেয়েটা দিয়েছিলো।
– ওহ! আপনি তাহলে সেই ময়দা সুন্দ্রী?
– কিহ!
– হুমম ।
– শুনুন আমি আপনাকে ফোন দিয়েছি শুধু ঐ সুন্দর মেয়েটার কথা রাখতে । নয়ত আপনার মত ক্ষ্যাত, বাঁদর মার্কা ছেলেকে ফোন দিতে আমার বইয়েই গেল ।

অনেকক্ষণ ধরে ঝগড়া চললো । একটা দীর্ঘ সময় ধরে নিঁখুত ভাবে ঝগড়া করায় যদি নোবেল পুরস্কার থাকত তবে তাকে হারানো আর আটলান্টিক সাঁতরে ওপারে যাওয়াটা একই রকম অসম্ভব ছিলো । যাইহোক, সেদিনের পর থেকে সে মাঝে মাঝে ফোন দেয় আর অনেকক্ষণ ধরে নিশুর সাথে কথা বলে । কি বলে আল্লাহই জানে! আমি মেয়েটিকে সহ্য করতে পারিনা । কোথাকার কেমন মেয়ে আল্লাহ্ তা’আলাই ভাল জানেন । তাছাড়া কখন কি করে বসে তারও কোন গ্যারান্টি নেই । নিশুও হয়েছে তেমন, কি দরকার অমন অজানা-অচেনা একটা মেয়ের সাথে এতটা ভাব জমানোর? যখন অসাধু ব্যক্তির খপ্পরে পড়বে তখনই বুঝবে ।

কিন্তু আমিই তো পৃথিবীতে ওর একমাত্র আপনজন, আমাকেই ওর ভাল-মন্দ নিয়ে ভাবতে হয় । তাই আজ সন্ধাই যখন ফোন দিয়েছিল তখন যেভাবে পেরেছি বলেছি, বলার পর থেকে মনে মনে একটা ভাললাগা কাজ করছে । কেমন জানি হিংসা হচ্ছিলো তার সাথে । কোথাকার কোন উটকো ঝামেলা আমার ভালোবাসার ভাগ নিতে এসেছে, হুহ্ ।

আপনারাই বলুন আপন আর পর কী কখনো এক হতে পারে? থাক আপনাদের আর কষ্ট করে বলতে হবেনা, আমি জানি পারেনা, কখনো তা সম্ভব নয় । আমি যে ওকে সেই ছোট্টটি থেকে কোলে-পিঠে করে আজ এতবড় করেছি, নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছি, দীর্ঘ দিন ধরে প্রতিটা রাতের অর্ধাংশ কোমলতা মিশিয়ে গান গেয়ে, তার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে নিজে ভেজা চোখে ঘুমাতে গেছি ।

তাকে নিজ হাতে মনের সাঁজিয়েছি এমনকি তার মনোমুগ্ধকর প্রতিটা কথার বুলির পিছনেও তো স্রষ্টার পরে আমার অবদান কম নেই । তো এতকিছুর পরেও আমার কি এতটুকু হিংসা করারও অধিকার নেই? থাকলে থাকবে না থাকলে না থাকবে, আই ডোন্ট কেয়ার ।

আজ আমার নিশুর স্কুলে প্যারেন্টস’ডে অনুষ্ঠান হচ্ছে । ওর স্কুলের গেট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করছি । চোখ দুটো লাল টকটক করছে, বোধহয় কয়েক ফোঁটা জল জমেছে নিজের অজান্তেই । বারবার একটি কথা আমার হৃদয়ে কাঁটার মত বিঁধছে তা হলো আজ প্রত্যকেটা ছেলে মেয়ে তাদের বাবা-মা’র সাথে অনুষ্ঠানে  উপস্থিত হয়েছেন, না জানি তা দেখে আমার কলিজার টুকরা কী করছে । হয়ত তার মন এতক্ষণ ছটফট করছে আমার অনুপস্থিতিতে ।

সকালে গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে খুব করে বলেছিলো আমাকে অন্তত আজ যেন একটু তাড়াতাড়ি যায় । কিন্তু লোকের চাকরী করা মানে নিজের স্বাধীনতা তার কাছে বন্দক রাখার মত, তাই সঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারিনি ।

কাঁপা-কাঁপা শরীর, মন নিয়ে ঢুকলাম অডিটোরিয়ামের ভিতরে । দেখলাম স্টেজে বসে আছে নিশু । কিন্তু তার মধ্যে কষ্টের কোন চিহ্ন না দেখে ভীষণ অবাক হলাম তবুও মনের মধ্যে একটা অঠেয় আনন্দের ঝিলিক আন্দোলিত হয়ে উঠলো । কিন্তু মূূহুর্তেই অবাক হলাম ওরপাশে স্টেজের কেন্দ্রবিন্দুতে বসে থাকা মানুষটিকে দেখে । এ যে সেদিনের সেই মেয়েটি!

এর পর থেকে নিশু প্রত্যেকদিন অনেকক্ষণ ধরে তার সাথে ফোনে কথা বলত । তবে আমি আর কিছু বলতাম না, কারণ নিশু তার সাথে কথা বলে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ওর চাঁদ মুখের হাসি দেখতাম । নিশু যে এত সুন্দর করে হাসতে শিখেছে তা আব্বু-আম্মু আমাদের ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে কখনো দেখিনি । ও তো সারাক্ষণ বিষন্নতায় থাকত । কিন্তু ও এখন আর বিষন্ন থাকে না । আগের চাইতে বেশি খুশি ভরা চাহনিতে ও আমার সাথে কথা বলে । বাগানে ফুলের সাথে কথা বলে । গালে হাত দিয়ে প্রজাপতি আর পাখিদের সাথেও গল্প করে । এখন আমি আসার আগেই মিষ্টি মেয়ের মত পড়তে বসে । আমার কোলে শুয়ে শুয়ে গান শুনায় । কে শিখিয়েছে জানতে চাইলে ঐ মেয়েটার কথা বলে । সব সময় আমার সামনে তার কথা বলত ।

নিশুর স্কুলে ছুটি চলছে । এরই মাঝে এক সন্ধ্যায় নিশু হটাৎ করেই বললো ওর নাকি খুব ফুসকা খেতে মন চাচ্ছে । বললাম তুমি বাসায় থাকো আমি গিয়ে নিয়ে আসি । তখন ও বলে যে, ‘ভাইয়ু আমিও যাব তোমার সাথে আর অমুক দোকানের ফুসকা খাব ।’

সন্ধার ঝলমলে শহরের কংক্রিটের রাস্তায় নেমে পড়লাম । নিশু আমার হাতের কড়ে আঙ্গুল ধরে ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে হাঁটছিলো আর আস্তে আস্তে গান গাচ্ছিল । আজ ওকে খুব শান্ত-শিষ্ট লাগছে । কারণ জানতে চাইলে বললো যে, পরে বলবে ।

দুই প্লেট ফুসকার অর্ডার করলাম কিন্তু ও আঙ্গুল উচিয়ে দেখালো তিনটে অর্ডার করার কথা । কারণ জানতে চাইলে ইশারায় পিছে তাকাতে বললো । তাকাতেই বেশ চমকে উঠলাম । দেখলাম ঐ মেয়েটা দাঁড়ানো । কিছু বলার আগেই দেখলাম নিশু তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো । আমি কিছু বলতে চেয়েও পারলাম না ।

উনাকে বসতে দিয়ে আমি একটু দূরে এসে দাঁড়িয়েছি । দূর থেকে দেখছি তারা দুজনেই খুব আনন্দিত । যদিও উনার মাঝে এক ধরনের ইতস্ততা ছিলো স্পষ্ট । সামনের ট্রেতে ফুসকা রেখে গেলো দোকানি মামা । তা দেখা মাত্র নিশু আমার হাত ধরে বসিয়ে দিলো মেয়েটির পাশের চেয়ারে । তারপর একবার আমি ওকে খাইয়ে দিচ্ছি একবার উনি দিচ্ছেন আর নিশুও ওর প্লেট থেকে একবার আমাকে আরেকবার উনাকে খাইয়ে দিচ্ছে ।

আজ ওর অনাবিল খুশির কাছে আমার হিংসুটে মনভাব কোন ভাবেই পাত্তা পেল না । উনি বেশ লজ্জাবতী হয়ে মাথা নিচু করে বসে আছেন । আমিও অবশ্য কম লজ্জা পাচ্ছিনা । হঠাৎ দেখি নিশু পাশে নেই । দুজনেই হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালাম, দেখলাম একটু দূরে বকুল গাছের নিচে ও দাঁড়িয়ে আছে । কাছে যেতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো । আমার মনের মধ্যে উথালপাথাল শুরু হয়ে গেলো । জানতে চাইলাম ওর কান্নার  কারণ। ও আরো জোরে কেঁদে উঠলো তারপর কিছুটা সময় নিয়ে কান্না করতে করতেই বলতে লাগলো

– তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসনা। ইইই । যদি ভালবাসতে তবে আমার কথা শুনতে । তুমি প্রতিদিন কত কষ্ট করে অফিস করে বাসায় এসে আবার আমার জন্য রাঁধতে যাও । ঘেমে নেয়ে রান্নাকরে আমাকে খাইয়ে দাও । অনেক সময় গ্যাস না থাকলে তুমি চোখের পানি দিয়ে রান্না করো, ধোঁয়া তোমার একদম সহ্য হয়না তবুও তুমি নিজে কষ্ট পাও, আমাকেও কষ্ট দাও । কিন্তু আমার কথা একটিও শুনো না ।

কেন? তুমি আমার জন্য কষ্ট পাবে? যাও তুমি যদি আমার কথা না রাখতে পারো তাহলে তুমি একাই চলে যাও । আমি যাবনা, যার কেউ নেই, যার কথা কেউ শোনে না তার আর বাসায় গিয়ে কী হবে? এই বলে আবার কাঁদতে লাগলো । যার ‘উহ!’ শব্দে আমি পাগলপারা হয়ে যায় তার কান্না আমার হৃদয়ে কতটুকু ক্ষত সৃষ্টি করছে তা নিশ্চয় বলার অপেক্ষা রাখেনা । ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললাম
– চাইলেই কি যখন-তখন কাউকে পাওয়া যায়? কান্না বন্ধ করো, পরে ভেবে দেখব কী করা যায় । আমার কথা শুনে কান্না থামলো বটে কিন্তু কথার ফুলঝুড়ি থামলো না । মুখে একচিলতে মৃদুলা হাসির রেখা ফুঁটিয়ে বললো

– চাইলেই পাওয়া যায়, আমি এনে দিব? ও ভাইয়ু বল না আমি যদি কাউকে চাই তাহলে কি তুমি তাকে আমার জন্য এনে দিবে না? এই মেয়েটা কি! এতক্ষণ কাঁদছিলো এখন আবার হাসছে, না জানি কিছুক্ষণ পরে আবার কী করবে! ওর কান্ড দেখে আমি নিজেও হেসে ফেললাম কিন্তু তা বাইরে থেকে বুঝতে দিলাম না । আমাদের দু’ভাই বোনের কাণ্ড দেখে পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর কি করা উচিৎ তা হয়ত খুঁজে পাচ্ছেন না ঐ ম্যাম ।

ও হ্যাঁ বলা হয় নি তো, ওই অল্প বয়স্কা মেয়েটি হলো নিশুর স্কুলের নতুন হেডম্যাম । কিছুদিন হলো জয়েন করেছেন । তখন থেকেই নিশুর সাথে পরিচয় হয়। আমাদের বাবা-মা বিয়োগের ঘটনা তাকে ব্যথিত করে । এজন্য উনি নিশুকে খুব স্নেহ করেন । সেই প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত তিনি স্কুল টাইমে নিশুর সকল খোঁজ খবর নিতো এবং আমার ব্যস্ততার জন্য না দেওয়া সময়ের অভাবও তিনিই পূর্ণ করেছেন ।

নিশু ঠিকমত মায়ের ভালোবাসা পায়নি তাই একজন মেয়ের স্নেহময় মমতা সহজেই ওর মনে মাতৃতুল্য স্নেহ, ভালোবাসা, মমতার স্বাদ এনে দিয়েছে । আর উনিও চায়তেন নিশুর মত একটা ফুঁট-ফুঁটে আদুরী মেয়েকে মাতৃস্নেহ দিয়ে তার অপূর্ণতাগুলো কানায় কানায় ভরিয়ে তুলতে । তারা দুজনেই সমান ভাবে দুজনার উপর দুর্বল হয়ে পড়েছে । তাই উনি কৌশলে নিশুকে দিয়ে এতকিছু করিয়েছেন ।  অনেক ভাল আর সম্মানের জব করেন তবুও নিশুর ভালোবাসার কাছে পরাজিত হয়ে আমাকে তার জীবন সাথী বানাতে উৎসুক ।

ভাবছেন আমি এতকিছু কেমনে জানলাম? জেনেছি নিশুর ইংলিশের ম্যাম, আমার ভার্সিটি লাইফের একজন ফ্রেন্ড শাইলার কাছে, তার কাছে ম্যাম উনার অভিব্যক্তি খুলে বলেছেন ।

কথাগুলো জানার পর থেকেই কেমন জানি মনে হচ্ছে । যার সুখের জন্য আমি নিজের সুখগুলো এক নিমিষেই বিলিয়ে দিতে পারি আজ তার এই আব্দার আমাকে ভাবিয়ে তুলছে । যদি হিতে-বিপরীত হয় তখন কি নিজেকে ক্ষমা করতে পারে? এসব ভাবছি ঠিক তখনই নিশুর ডাক আবার বাস্তবে ফেরালো । বললো তার ম্যাম কিছু বলতে চায় । মাথা নেড়ে বলতে বললাম । উনি শুরু করলেন, আমি মাথা নিচু করে শুনছি…

নির্বাচনী ইশতেহারের মত তার সকল অভিপ্রায় বর্ণনা যখন শেষ তখন আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়লেন । অনেক কঠিন প্রশ্ন । প্রথম বারের মত তাকালাম তার চোখের দিকে । চোখের কোনে জমে থাকা কয়েক ফোঁটা জল চিকমিকি করছে ল্যামপোস্টের নিয়ন বাতির পসরায়। নিশুর সাকাঙ্ক্ষিত দৃষ্টিও তার অনুরূপ । মন বলছে হয়ত এ চোখের জল বিশ্বাসঘাতকতা করবেনা । নিশুকে উঁচুকরে তার কোলে উঠিয়ে দিয়ে বললাম, পারবেনা এই আমানত সঠিক ভাবে সংরক্ষণ করতে? সঙ্গে সঙ্গে তার চোখে আটকে থাকা জল গুলো টুপটুপ করে ঝরতে লাগলো আর উনি চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে তুলতে লাগলো নিশুকে । নিশুও হাতের আলতে ছোঁয়াই মুঁছে দিতে লাগলো উনার গড়িয়ে পড়া জলকণা । আর আমার বুকের একপাশ থেকে মনে হলো বহুদিনের জমিয়ে রাখা ভয়ের লেশগুলো ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে ।

শেষ হলো আমাদের ভালোবাসার গল্প।

ভাই বোনের ভালোবাসার গল্পটি ২০১৬ এর কোনো একসময় লেখা!

কেমন লাগলো জানাবেন কমেন্টে। আপনি কী আরও ভালোবাসার গল্প পড়তে চান?

ডি এইচ শিশির 

Share with Friends

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top