গল্প: আহব্বান – ডিএইচ শিশির

আহব্বান

ডি এইচ শিশির

-‘কি ব্যাপার, আমাকে না নিয়েই তোরা আড্ডা শুরু করে দিয়েছিস?’ নাফিস তার বন্ধুদের উদ্যেশ্যে বললো । সবাই ‘না’ সূচক মাথা নাড়ল তারপর জাহিদ বললো – ‘কি যে বলিস? তুই আমাদের সবার মধ্যমণী । তোকে ছাড়া কি আমরা শুরু করতে পারি? কি বলিস তোরা?’ জাহিদ নাফিসের কথার উত্তর দিয়ে সবার সমর্থনের আশায় পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল । সবাই তাকে সমর্থন করলো । তখন নাফিস বললো – ‘আসলেই তোদের মত বন্ধু পাওয়া এই হতভাগ্যেরও পরম সৌভাগ্য । মহান আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে রহমত, নাজাত এবং মাগফিরাতের বাণী নিয়ে মাহে রমজান সমাগত । তোদের প্রস্তুতি কেমন?’ – ‘আমার অবস্থা আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো । আমি এবার সবকয়টি রোজা রাখার নিয়ত করেছি আলহামদুলিল্লাহ্‌।’ বললো জাহিদ। আরিফও একইরকম সুর মেলাল । মারুফ এবং ফরিদের চুপ করে থাকাতে কপালে ভাঁজ পড়লো নাফিসের । তাই আবার জানতে চায়লো – ‘কি ব্যাপার আমাদের ক্রিকেটর সাহেবরা চুপ কেন? কোনো সমস্যা নেই তো?’ – ‘না মানে.. আসলে রমজান মাসে আমাদের জেলা টিমের খেলা আছে । ওখান থেকে ভাল পার্ফর্মারদের নিয়ে ন্যাশনাল টিমের জন্য বাছায় পর্বের একটা ম্যাচ হবে তাই যদি রোজা থাকি তাহলে…’ কাঁচুমাচু করে বললো মারুফ । তার কথায় সহমত দিতে মুখ নিচু করে মাথাটা উপর নিচে নাড়ল ফরিদ । জাহিদ নীরব দর্শক আর নাফিস ঠোঁটে কামড় দিয়ে ভাবছে তাদেরকে কিভাবে সিয়াম পালনের পক্ষে যুৎসই জবাব দেওয়া যায় । অন্যরাও নাফিসের পাল্টা জবাবের জন্য অপেক্ষা করছে । কিছুক্ষণ সময় নিয়ে তাদের দিকে তাকালো নাফিস । তারপর বলতে আরম্ভ করলো – ”দেখ বন্ধু, মহান আল্লাহ্‌ তায়ালা পবিত্র কোরআনুল কারীমের মধ্যে বলছেন ‘আমি মানুষ এবং জ্বিন জাতীকে সৃষ্টি করেছি একমাত্র আমার ইবাদাত করার জন্য’ সূরা যা-রিয়াত – ৫৬ এখন মনেকর, তুই আমার বস্। আমাকে শহরে পাঠিয়েছিস কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা করতে কিন্তু আমি আসল কাজ বাদ রেখে অনর্থক সবকিছু করলাম তারপর দিন শেষে খালি হাতে ফিরলাম অথবা অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ ফিরে এলাম। তখন তোর প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? প্রশ্ন করে তাকালো মারুফ আর ফরিদের দিকে । – ‘অবশ্যই ভীষণরকমের রাগ হবে আমার ।’ ফরিদ বললো – ‘আমারতো মাথা একদম হ্যাঙ হয়ে যাবে । প্রচণ্ড রাগ হবে। সামান্য একজন কর্মচারী হয়ে আমার কথাকে অবহেলা করা!’ বললো মারুফ । তাদের উত্তর শুনে একটু শক্ত কণ্ঠে নাফিস বলল – ‘সামান্য এতটুকু কারনেই রাগ হবে কেন?’ নাফিসের কথায় কিছুটা রাগান্বিত হয়ে উত্তর দিলো ফরিদ – ‘কি বলিস! রাগ হবেনা? আমি কিনা তোর বস্ আর তুই আমার কথা অমান্য করে আজে বাজে কাজ করে বেড়াবি আর আমি সেটা মেনে নিব কেন?’ ওর উত্তর শুনে একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো নাফিস। তারপর বলতে লাগলো – একজ্যক্টলি, আমিও পুরোপুরি সহমত তোর সাথে । দেখ, তুই সামান্য একজন বস্ হয়ে যদি কর্মচারীর এতটুকু অগ্রাহ্য সহ্য করতে না পারিস, তাহলে আমরা সবাই ছিলাম নিষ্প্রাণ । একটাসময় আমাদের কোনো অস্তিত্বই ছিলো না। মহাবিশ্বের সমস্ত সৃষ্টির স্রষ্টা আল্লাহ তা’আলা আমাদের সৃষ্টি করে জীবন দান করলেন, প্রতিনিয়ত মহামূল্যবান অক্সিজেনসহ জীবনধারণের সবরকম উপকরণ দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আর তিনি এতসব কিছু করছেন শুধু আমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য। তিনি আমাদের সুস্পষ্ট কিছু দিকনির্দেশনা দিয়ে সেগুলো মেনে সেই অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে বলেছেন। এরপরও যদি আমরা সেই মূল দায়িত্ব মানে আল্লাহর ইবাদত করা ভুলে গিয়ে নিজ খেয়ালে অযাচিত কার্যকলাপ করি তাহলে কি তিনি আমাদের ছেড়ে দিবেন? আমাদের কি তার কাছে এসবের জন্য জবাবদিহিতা করা লাগবে না? আজ হয়ত আমরা এই পরীক্ষা ক্ষেত্রে নিজ খেয়ালে বিচরণ করছি, কিন্তু দিন শেষেতো আমাদেরকে তার নিকট প্রত্যাবর্তন করতেই হবে । আর সেই প্রত্যাবর্তন যদি হয় রিক্তহাতে তখন তিনি কি আমাদেরকে ক্ষমা করবেন? প্রিয়বন্ধুগন ক্ষমার দরজা কিন্তু দুনিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত সচল ।’ একনাগাড়ে কথা গুলো বলে থামলো নাফিস । অল্পক্ষণ সময় নিয়ে পাল্টা জবাবদিল মারুফ – ‘আমরাতো সব সময়ই সকল ইবাদাত করে থাকি । কিন্তু এবার একটু ঝামেলার কারণে যদি ইবাদাত না করি তবে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে পড়বে?’ তার কথা শুনে নাফিস একটু ভ্রুকুঞ্চণ করলো তারপর একটি হাদিসের কিছু অংশ তেলাওয়াত করে শুনাতে লাগলো – “হযরত আবু যার গিফারী (রা) হতে বর্ণীত তিনি বলেন, রাসুল (স) তাঁর সুমহান প্রভু হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি (আল্লাহ) বলেন, ‘হে আমার বান্দারা! যদি তোমাদের প্রথম ও শেষ মানুষ ও জিন সকলেই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় একজন পরহেজগার ব্যক্তির হৃদয়ের মতো হৃদয়ের অধিকারী হয়ে যায়, তাহলে এটা আমার রাজত্বের কোন কিছুই বৃদ্ধি করতে পারবেনা । হে আমার বান্দারা! যদি তোমাদের প্রথম ও শেষ মানুষ ও জিন সকলেই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় একজন পাপীর হৃদের মত হৃদয়ের অধিকারী হয়ে যায়, তাহলে এটা আমার রাজত্বের কোন কিছুই কমাতে পারবেনা ।” হাদিসের কথা শুনে এবার মারুফ বেশ লজ্জা পেলো । আর ফরিদ বেশ নমনীয় ভাবে বলল – ‘দোস্ত, আমরা একাগ্র চিত্তে ইবাদাত করতে পারব তখনই, যখন আমাদের সমুদয় আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতে পারব । এক কথায় ভাল একটা প্রফেশনে যেতে পারব । আর এখনই আমাদের ভাগ্য প্রসন্ন করার উপযুক্ত সময় । প্রথমে একটা ভালো জব করো তারপর তারপর নিশ্চিন্ত মনে আল্লাহর ইবাদত করো। বান্দাও খুশি আল্লাহ ও খুশি।’ তার কথার সাথে মারুফ ও সহমত দিলো । কিন্তু জাহিদ বললো – ‘তাহলে তোরা বলতে চাস যারা ভাল প্রফেশনে নেই তারা একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদাত করতে পারেনা? হুরর! এটা কোনো যুক্তি হলো? আশাকরি এর সুন্দর উত্তরও নাফিসের কাছে রয়েছে ।’ নাফিস মুচকি হাসলো তারপর বলতে আরম্ভ করলো – ‘মহান আল্লাহ তায়ালা হলেন স্রষ্টা । তিনিই সর্বজ্ঞ যে, কার প্রফেশন কোথায় মানাবে । আর তিনিই তা নির্ধারণ করে দেন। যার ভাগ্য যেখানে থাকে সেটাই তার জন্য উত্তম। তাই একটা ফরজকে উপেক্ষা করে নিজের ভাগ্য প্রসন্ন করতে চাওয়াটা সবচাইতে বড় বোকামি । কারণ শুধুমাত্র তোমার চেষ্টাই তোমাকে সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ এনেদিতে পারে না । পরিশ্রম, চেষ্টা আর আল্লাহ তা’য়ালার অনুগ্রহের সমন্বয়েই কেউ পৌঁছে যেতে পারে শিকড় থেকে শিখরে ।’ সুন্দর কৃতজ্ঞতার হাসি জাহিদের মুখে । কিন্তু ফরিদ তখনও প্রশ্ন ছুড়তে লাগলো – ‘উহু তুই বুঝতে পারছিসনা! তাছাড়া আমরাতো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বই । শুধুমাত্র রোজা….।’ তার কথা শেষ না হতেই নাফিস বলতে আরম্ভ করলো – ‘ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ । তন্মধ্যে নামাজের পরেই সিয়াম বা রোজার অবস্থান । এখন আমরা যদি সব কয়েকটি নিজের মধ্যে ধারণ করি কিন্তু একটি বাদ দিই তবে কি অন্যগুলোর দুর্বলতা প্রকাশ হবে না? আরো একটা উদাহারন দিই বিষয়টা বুঝতে সুবিধা হবে ।’ এই যে ধর তোর হাতে যেই ফোনটা আছে, এটা দ্বারা এখন তুই কোথাও ফোন করবি । তাহলে তোকে অবশ্যই এগারো ডিজিটের নং ডায়াল করতে হবে অথবা যদি ফরেইন হয় তবে নির্দিষ্ট সংখ্যা । তাই না? কিন্তু তুই যদি সবগুলোর থেকে যে কোন একটা ডিজিট ডায়াল না করিস তবে কী ঘটবে?” – ‘সহজ প্রশ্ন, সহজ উত্তর, ফোন কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছাবেনা ।’ ফরিদ বললো । মারুফ, জাহিদ আর আরিফ সবাই একমত । সবার মতামতের পরে নাফিসর কিছুক্ষণ চুপথেকে আবার বলতে আরম্ভ করলো – ‘দুনিয়ার সাধারণ একটা ফোনকল যদি নির্দিষ্ট নিয়মের সুষ্ঠু ব্যাবহার না করায় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারে তাহলে তোমরা কিভাবে ভাবতে পারো যে, আমাদের স্রষ্টার দেখানো সর্বত্তম নির্দেশনা অনুসরণ না করেই নিজ ইচ্ছা মত জীবন পরিচালনা করলে তোমার আমার এই ইবাদত তাঁর নিকট গ্রহণযোগ্যতা পাবে?’ নাফিসের কথা শুনে সবাই চুপ । জাহিদ কথা বলে উঠল – ‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস বন্ধু । ভেবে দেখ যখন আমাদের পরিক্ষার রেজাল্ট দেওয়া হয় এবং সবগুলোতে লেটার মার্ক পাওয়া সত্ত্বেও যদি একটা বিষয়েও ফেইল আসে তবে সবমিলিয়ে কিন্তু রেজাল্ট এফ গ্রেডই আসে ।’ তার কথায় একমত হলো নাফিসসহ বাকি সবাই । তখন নাফিস আবার বললো – ‘জীবন পরিচালনায় সব ক্ষেত্রেই পরিপূর্ণ ভাবে আল্লাহ তায়ালার অনুশাসন মেনে চলার মাঝেই থাকে অকৃত্রিম শান্তির অনুভূতি । তাই আমাদের উচিৎ পরিপূর্ণভাবে ইসলামের সকল রীতিনীতি মেনে চলা । কারণ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘ ইসলামই হলো আমার নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য জীবন ব্যবস্থা ।’ শিশিরের কথা শুনে ফরিদ এবং মারুফ তাদের ভুল বুঝতে পারলো । সাথে জড়িয়ে ধরলো তাকে । শিশির দেখলো জাহিদের চোখে জল । আর ভেজা চোখে তাকিয়ে আছে ফরিদ, মারুফ আর আরিফ । সবাই প্রতিশ্রুতি দিলো আল্লাহ চাহেতো এবারের প্রত্যেকটা রোজা থাকবে ওরা । খুশি হয়ে নাফিস বলল, ‘ঠিক আছে তাহলে প্রথম রোজার ইফতারি আমিই করাব ইনশাআল্লাহ।’ সবাই খুশিতে ‘আলহামদুলিল্লাহ্’ বললে উঠলো। ঠিক তখনই দূর থেকে মাগরিবের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসতে লাগলো । সবাইমিলে দূর্বাঘাসের চাঁদরে দাঁড়িয়ে জামায়াতের সাথে নামাজ আদায় করে নিল । নামাজ শেষ হতেই দূর হতে চিল-চিৎকারের আওয়াজ ভেসে আসতে লাগলো । তখন তারা দেখলো আাঁধারের বুক চিরে চারিদিকে নুরের আলোকরশ্মি ছড়াতে ছড়াতে কাঁচির মত চাঁদ উঠছে । সাথে সাথে সবাই মিলে সমস্বরে গেয়ে উঠল, ‘একটি বছর পরে এলো রমজান রহমাত, নাজাতের করে আহ্বান..।’

Share with Friends

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top