গল্প : মুমতাহানার স্বপ্ন – ডি এইচ শিশির
ফারহানা আফরোজ আর শিশিরের একমাত্র মেয়ে মুমতাহানা মেহজাবীন দিয়া। ছোট্ট একটা পুতুলের মতো মেয়ে। যেন এক আদুরে রাজকন্যা।
ছোট হলেও বড়বড় প্রশ্নে জর্জরিত করে বাবা- মা’কে। জানার তার অদম্য আগ্রহ। বাবা মা ছোট্ট মুমতাহানার প্রশ্নগুলো উপভোগ করে।
তাকে সুন্দর করে সবকিছু বুঝিয়ে দেয়। মুমতাহানাকে নিয়ে ওদের চোখভরা স্বপ্ন।
ফারহানা নামাজের সময় মুমতাহানাকে নিজহাতে ওজু করিয়ে দেয়। সুন্দর করে গুছিয়ে দেয়। এবং নিজের পাশে নামাজে দাঁড় করিয়ে দেয়।
মুমতাহানাও তাকে অনুসরণ করে রুকু, সেজদা, বৈঠকে বসে। তাকে পাখির পালকের মতো তুলতুলে জায়নামাজ কিনে দিয়েছে শিশির।
এটা ফারহানা আফরোজের বুদ্ধি। ওর কথা হলো, প্রথমে বিভিন্নরকম আকর্ষণীয় জিনিষ ওকে মনটাকে নামাজের দিকে আগ্রহী করা।
তারপর আস্তেআস্তে একসময় অভ্যাস হয়ে যাবে। তখন ওকে আর ডাকা লাগবে না। নিজেই নিজের দায়িত্ববোধ থেকে সে নামাজে আদায় করবে।
শিশির মাঝেমাঝে বলে, – ‘কি ব্যাপার বলতো, ফারহানা? ও এতটুকু একটা মেয়ে! ওর তো নামাজ বাধ্যতামূলক নয়। এইবয়সে এতো বেশি বোঝা না দিলে কি হয় না?’
শিশিরের কথা শুনে। বুদ্ধিৃমতী মেয়ে ফারহানা আফরোজ নিজের স্বরটা একটু নিচু করে বলে, – ‘দেখ, এখনই উপযুক্ত সময় ওকে গড়ে তোলার।
আর,
এই উপযুক্ত সময়েই যদি ওকে সঠিক পথ দেখিয়ে দিতে পারি। তবে ইনশাআল্লাহ্! ও ঠিকই দুনিয়াতে যেই লক্ষ ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের মহৎ পরিকল্পনাকে সামনে রাখবে। তাকে সৃষ্টি যে কারণে সেপথও অতি দৃঢ়তার সাথেই অতিক্রম করতে পারবে।’
ফারহানা আফরোজ একজন উচ্চশিক্ষিত ধর্মপরায়ণ মেয়ে। শিশির মাঝেমধ্যে রেগে যায় অথবা ত্যক্ত কণ্ঠে বলে।
তখন ফারহানা কণ্ঠকে কোমলত্বে ছেয়ে নেয়। বিনয়সহকারে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করে। শিশিরও তখন ওর অভিপ্রায় বুঝতে পারে।
তখন যুক্তিখণ্ডন না করার বদলে কিছুটা লজ্জা প্রকাশ করে। ফারহানার যুক্তিসংগত কথা মেনে নিয়ে আবার আরেকটা টপিকের দিকে এগোয়।
একদিন সকালের গল্প।
তখন শিশির অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর ফারহানা মুমতাহানাকে গোছগাছ করে দিচ্ছে। শিশির যাওয়ার পথে মুমতাহানাকে স্কুলে ড্রপ করে দিবে।
তখন, স্বভাবত ছোট্টছোট্ট বিনুনি দুটি মাথার দুদিকে হেলানি- দুলানি দিতে লাগলো। মুমতাহানা আদুরে কণ্ঠে শিশিরকে লক্ষ্য করো বলল , – ‘পাপা, ও পাপা শোন না।’
শিশির ড্রেস পরতে পরতেই বলল, – ‘হ্যাঁ মামণী, বলো’
– ‘আমি তো রোজ স্কুলে যাই কিন্তু আমাদের বুয়া আন্টির মেয়ে হাসনা, ও কেন স্কুলে যায় না? পাপা’ মুমতাহানা মুখে মৃদু গাম্ভীর্য টেনে বলল।
ওর একথা শুনে শিশিরের মুখটা বিষন্ন হবে গেল। যে হাসির প্রদীপ জ্বলছিল তা দপ করে নিভে গেল! কিছুটা পাল্টে গেল ফারহানার মুখের চাহনিও।
শিশিরকে যেন বিব্রত হতে না হয়। তার জন্য ফারহানা মেয়ের মুখে আলতোভাবে হাত বুলিয়ে বলল, – ‘মা, তুমি তো এখনো অনেক ছোট্ট। এসব তুমি বুঝবে না।’
মুমতাহানা মায়ের কথা মেনে নিল। সুবোধ মেয়ের মতো বাবার সাথে স্কুলে চলে গেল।
কয়েকদিন পরের কথা।
ডিনারের সময়। বাবা- মায়ের মধ্যে কথা হচ্ছে মুমতাহানার ক্লাস পরিবর্তনের বিষয়ে। স্কুলের পরীক্ষায় ও সেরা মার্কস নিয়ে ক্লাস উত্তীর্ণ হয়ে টু তে উঠেছে।
তো, এরই মধ্যে মুমতাহানা বলে উঠল, – ‘পাপা, জানো? রেজাল্ট আউটের পর হেড ম্যাম আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন আমি নাকি বড় হয়ে গেছি। হি হি হি হি। তারপর একগাদা গল্প শুনালো।’ একগাল হেসে দিল ও।
ওর হাসি দেখে বাবা- মায়ের মুখেও এক চিলতে হাসি ফুঁটে উঠল।
এরপর আম্মুর দিকে তাকিয়ে বলল, – ‘আম্মু,
তুমি না একদিন বলেছিলে? বড় হলে আমি বুঝতে পারব। বুঝব হাসনার কেন আমার মতো বই নেই, খাতা নেই ব্যাগ নেই। ও কেন স্কুলে যায়না?’
– ‘হু’ মাথা নেড়ে কৌতূহলী চাহনি নিয়ে উত্তর দিল ফারহানা।
তারপর,
আবার শুরু করল মুমতাহানা, – ‘গতকাল আরবি টিচার কী বলেছিলেন জানো? বলেছিলেন যে গরীব, অসহায় পরিবারের ছেলে- মেয়েরা স্কুলে আসেনা।
ওরা নাকি ঠিকমতো খেতেই পারেনা। তো পড়াশুনা করবে কিভাবে? এটা আমি এর আগে বুঝতে পারিনি। আম্মু, তুমি ঠিকই বলেছিলে। আমি তো এখন বড় হয়ে গেছি। তাই সব বুঝতে পেরেছি তাই না?’
মুমতাহানার কথা শুনে গোলগাল চোখদুটি বড়বড় হয়ে গেছে ফারহানা আর শিশিরের। ফারহানা কোনোরকমে নিজেকে সংবরণ করে ওর কথার ‘হ্যাঁ’ বোধক জবাব দিল।
উত্তরের অপেক্ষা না করে মুমতাহানা আবার বলতে আরম্ভ করল, – ‘পাপা, ও পাপা আমরা তো ওদের মতো গরীব নই।
আমাদের গাড়ি আছে। অনেক বড় বাড়ি আছে। বাড়ির সামনে পুকুর আছে। অনেক টাকাও তো আছে তোমার তাই না, পাপা? কিন্তু হাসনাদের তো কিছুই নেই।
আমাদের কিচেনের মতো একটা ছোট্ট ঘর ছাড়া। আমরা কি পারিনা আমাদের অনেক টাকা থেকে কিছুটাকা ওদের দিতে?
তাহলে হাসনাও আমার মতো পড়াশুনা করতে পারবে। স্কুলে যেতে পারবে। অনেক আনন্দে নতুন বছর শুরু করতে পারবে। আমার মতো ওরও অনেক বন্ধু হবে।
আমি কি পারিনা ওকে পড়াতে? ওর মুখে হাসি ফোঁটাতে? বল না, পাপা? বল? ও পাপা..?
মুমতাহানার মিষ্টি কণ্ঠ থামলো। কাঁপাকাঁপা স্বরে বলা কথাগুলো প্রতিধ্বনি হয়তে হতে লাগলো। ভেসে এসে কাঁটার মতো বিধল শিশির আর ফারহানার মনে।
আর একসাথে দুজনেরই মন খুশিতে আন্দোলিত হতে লাগলো। তারা মেয়েকে সঠিক শিক্ষা দিতে পেরেছেন। আনন্দাশ্রু এলো চোখে।
বিন্দু বিন্দু খুশি টলমল করতে লাগলো। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। হাতের শেষ লোকমা পর্যন্ত কখন নিচে প্লেটের উপর পড়ে গেছে। তবুও তা খেয়াল নেই কারোরই..।