গল্প: নিয়তির বিচার
ডি এইচ শিশির শরৎকালের নীল আকাশ । মেঘপুঞ্জ ভেসে চলছে ধীরস্থীর গতিতে । মাঝেমাঝে মনে হচ্ছে মেঘগুলো ইচ্ছামত আকৃতিসদৃশ হয়ে উড়ে চলছে । কখনো পাহাড়, কখনও নদী, কখনওবা আবার জানা- অজানা বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি তার মাঝে ফুটে উঠছে । পুষ্প তার চশমাটি হাতে নিয়ে আনমনে এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে । মাঝেমাঝে স্বচ্ছ- শীতল বাতাসে তার চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে । লালিত্য কলরব তাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো আচ্ছন্ন করছে। কিসের কলরব তা একটু পরে বলছি। এমনই কাটলো কিছু মুহূর্ত। হঠাৎ এক খণ্ড মেঘ থেকে ঝুমঝুম করে ঝরে পড়া বৃষ্টির মত তার স্নায়ুতে এসে টোকা দিলো একটুকরো স্মৃতি । পুষ্প যখন আনমনে কোন কিছু দেখে তখন খোলা দৃষ্টি আচমকা ঝাপসা হয়ে আসে । ফেলে আসা দিনগুলিতে ঘটে যাওয়া স্মৃতিকথা তার চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু নিপতন করে । আজও তার ব্যতিক্রম হলো না ।
মনমাঝি পালতোলা নৌকা বেয়ে ভেসে চললো তার ঠিকানায় । স্মৃতিপটে আবছা- অস্পষ্টতায় ভেসে উঠলো একটি মুখ । স্বার্থপরতার দুনিয়াতে স্বার্থান্ধ একজন মানুষের মুখ । একসময় তার ঐ কোমল মুখে জড়িয়ে থাকত সম্মান আর ভালোবাসার প্রলেপ। আজ তার জন্য সেই মন, সেই একই হৃদয় কুঠিরে জায়গা করে নিয়েছে একরাশ জমাটবদ্ধ তীব্র ঘৃণা । মনুষ্যজাতি এক অদ্ভুতুড়ে নিয়মের শৃঙ্খলে বাঁধা তাই যতই সুখের আবেশে নিজেকে হারাতে চায়, ততই অতীতস্মৃতি তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে ।
বছরকয়েক আগের কথা । পুষ্প এবং পল্লবের ছোট্ট সংসার ছিলো কানাই-কানাই ভালোবাসায় পূর্ণ। তাদের প্রতিটিদিন ছিল স্বপ্নিল। দু’জনের মধ্যে ছিলো অকৃত্রিম ভালোবাসা। পল্লবের সারাদিনের পরিশ্রান্তি পুষ্পের চাঁদ মুখের একচিলতে হাসিতে মুহূর্তেই মিলিয়ে যেত। এভাবেই তাদের দিনগুলো অতিবাহিত হচ্ছিলো যেন কাঁঠ পেন্সিলের আঁচড়ে আঁচড়ে নিজহাতে অঙ্কন করা স্বপ্নোত্থিত রূপকল্পের মতো । কোনো এক নতুন ভোরে প্রতিটি দিনের মতই স্বপ্নবৎ চোখ মেলল পুষ্প। তারপর বেশ সময় নষ্ট করে সাজুগুজু করে পরম নির্ভরতায় পল্লবের কাঁধে মাথারেখে হুড তোলা রিকশায় চড়ে অনেক আনন্দ নিয়ে পুষ্প গেলো ডাক্তারের কাছে । উদ্দেশ্য; পল্লব বলেছে কিজন্য তাদের বেবি হচ্ছেনা তার চেকআপ করাতে হবে।
তাই বেশ উৎকণ্ঠা নিয়ে তারা গেলো ডাক্তারের কাছে। পুষ্পও অধীর আগ্রহী জানতে যে ঠিক কবে নাগাদ সে তার পাশের মানুষটিকে পৃথিবীর সবচাইতে বড় উপহারটির সুসংবাদ জানাতে পারবে। কবে সেই সংবাদটি দিয়ে আঁচলে মুখ ঢেকে লজ্জাবতী দৃষ্টিতে তার স্বামির বুকে মুখ লুকাবে। একটি মেয়ের কাছে সব চাইতে বড় চ্যালেঞ্জ হলো স্বামীকে তার পরবর্তী প্রজন্মের বাঁতী উপহার দেওয়া। তাকে কোমল হাতের ছোট্টছোট্ট আঙ্গুলের স্পর্শ পেতে এবং অতি মোলায়েম, মিষ্টি- ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে পাপা ডাক শুনতে দেওয়া। স্বাদ- আহ্লাদ জলাঞ্জলি দিয়ে কয়েকফোঁটা শুক্রাণুকে নিজের মধ্যে বড় করা। চোখ থেকে গাল বেয়ে নেমে যাওয়া অঝোর অশ্রুফোঁটা নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে একবালতী রক্ত ঝরিয়ে, অবর্ণনীয় কষ্টকে বরণ করে নিয়ে রাতভর জেগে ছোট্ট বাবুনীকে একটু একটু করে বড় করে তোলা যেমন কষ্টের, তেমনি ছোট্ট বাবুটার বাঁকা ঠোটের হাসির মাঝেও থাকে সীমাহীন আনন্দ। সে কথা মনে হতেই পুষ্পের মন হঠাৎ করেই অন্যরকম আনন্দে নেচে উঠলো। কিন্তু সে বুঝতে পারেনি এটিই তার জীবনের শেষ বারের মতো কষ্টের লেশ বিহীন আনন্দের স্পন্দন। হাসপাতাল- ই যে তাকে জীবন্মৃতে পরিণত করতে অপেক্ষা করছে তা ও আন্দাজ করতে পারেনি।
বহুল প্রতিক্ষার সেই চেকআপের রেজাল্ট পুষ্পের জীবণে নেমে এলো দুঃখের আঁধার হয়ে। সে নাকি আর কখনওই তার স্বামীকে বাবা হওয়ার স্বাদ এনে দিতে পারবেনা। এই খবর শোনার পর তার স্বামীর লোকদেখানো ভালোবাসাগুলো রূপ পরিবর্তন করতে শুরুকরে। এবং তা চূড়ান্তভাবে থামে বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়িয়ে। পুষ্পের চোখ থেকে নেমে আসা জলকণা আর প্রাণবন্তকর চেষ্টা কোনো ভাবেই সম্পর্কটি আর জোড়া লাগাতে পারলোনা।
মান- অভিমানে প্রথমত দুজনার অবস্থান থাকত একজন বেডের এপাশে মুখ করে আরেকজন ওপাশে ফিরে থাকত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের মাঝে সৃষ্টি হল বিশাল স্পেস। দুইজন চলে গেলো দুই দিগন্তে। একদিকে একজনের সাজানো স্বপ্ন ভেঙ্গে দু’টুকরো হয়ে গেলো অন্যদিকে অপর প্রান্তের মানুষটি নতুন একটি সম্পর্ক গড়তে উৎকণ্ঠী হয়ে পড়লো।
ঘর্মাক্ত মুখে অনিন্দ্য হাসি নিয়ে বিন্দু বিন্দু পরিশ্রমে সাজানো সংসার ছেড়ে চোখে বাঁধভাঙ্গা অশ্রু কণা নিয়ে অনন্তের পথে পা বাড়ালো পুষ্প । পিছু ফিরে একবার নিষ্ঠুর মানুষটির চেহারা দেখে নেয় তারপর হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের কোনে জমে থাকা জলটুকু মুছে বিদায় নেয় সেখান থেকে।
তারপর কেটে গেছে বহুদিন। সবে দ্বাবিংশের কোঠাস্পর্শ করা পুষ্প সর্বাঙ্গে যৌবনের উচ্ছলিত চঞ্চল্যতাকে সংবরণ করে দ্বিতীয়বার আর কোনো বৈবাহিক সম্পর্কে নিজেকে না জড়াতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে জীবনটাকে একটু অন্যরকম ভাবে উপভোগ করার।
পিতৃসুত্রে পাওয়া অঢেল সম্পদগুলো কাজে লাগাতে লাগলো মানবতার কল্যাণে। সবচাইতে সুন্দর- প্রশংসনীয় চিন্তার বহিঃপ্রকাশ হলো অনাথ- অবহেলিত শিশুদের আশ্রয় দেওয়া এবং নিজের অক্লান্ত পরিশ্রম দ্বারা তাদের মাঝে শিক্ষার দ্যুতি ছড়িয়ে দেওয়া। তিনি এখন বাচ্চাদের ধর্মীয় এবং নৈতিক শিক্ষা দানের কাজে নিজেকে সবসময় ব্যস্ত রাখেন। কারণ বর্তমান সমাজকে পরিবর্তন- পরিবর্ধন করে একটি আদর্শিক সমাজ বিনির্মাণ করতে প্রয়োজন এক ঝাঁক দূর দৃষ্টিসম্পন্ন, নীতিজ্ঞানে জ্ঞানী আদর্শ তরুণ। সময়ের সাথে হাঁটিহাঁটি পা পা করে আস্তে আস্তে বাস্তবায়িত হতে থাকে তার প্রণীত রূপকল্প।
প্রভুর ঔচিত্য বুঝি এমনই হয়! যে পুষ্প কখনো মাতৃত্বের স্বাদ পাবেনা বলে স্বামি সংসার থেকে বিতাড়িত হয়েছিলো; আজ তার কোলে আশ্রিত আছে একঝাঁক কোমলমতি শিশু- কিশোর। তাদের পরিচর্যা- দেখাশোনার ফাঁকে কেমনকরে দিন কেটে যায় বুঝতেই পারেনা। বাচ্চাদের পবিত্র মুখে ফুটে ওঠা নির্মল হাসি তার পথ চলার নিয়ামক। অনাথ বাচ্চাগুলো যখন ফোকলা দাঁতে হাসি মুখে তাকে একলা পরী ও তার আদরের কয়েকটি পাখির গল্প শোনায় তখন সে সব দুঃখ ভুলে যায়। নতুন আরেকটি স্বপ্নিল দিন আগমনের প্রতিক্ষায় থাকে।
অন্যদিকে সারাদিন বর্তমান বউয়ের সাথে ঝগড়া- ঝঞ্ঝাটে দিনযাপন করতে করতে আজ বড় ক্লান্ত পুষ্পের সেই স্বামী। তাকে রেখে বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার থ্রেট হলো তার নিত্যদিনের প্রাপ্তী। তুমি কার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করো? আল্লাহ তায়ালার ষড়যন্ত্র হলো সবচাইতে কঠিন ষড়যন্ত্র! সে তখন পর্দার অন্তরালে যা সৃজন করেছে আজ সেটি নিত্য মৃত্যু যন্ত্রণা হয়ে তাকে কাতর করে তোলে। একটি নিষ্পাপ মুখ তখন তার স্মৃতিতে ভাসে। মনে পড়ে তারসাথে করা অন্যায়গুলোর কথা।
ঘরে স্ত্রী রেখে অবৈধ্য সম্পর্কে জড়িয়ে গার্ল ফ্রেণ্ডের কু-পরামর্শে পুষ্পকে চেকআপ করার নাম করে হাসপাতালে নিয়ে নাটক সাজিয়ে তাকে গভীর ষড়যন্ত্রে ফাসিয়ে গৃহচ্যুত করার কথাও মনে পড়ছে আজ।
সবকিছুই পরিকল্পনা মতো হয়েছিলো কিন্তু সাড়ে চার বৎসরের সংসারীক জীবনে তাদের বাচ্চাকাচ্চা না হওয়ার রহস্য উদঘাটন হলো কিছুদিন আগে। এবং নির্দোষ একটি মেয়ের উপর আরোপিত মিথ্যা- সত্য হয়ে ধরা দিলো তার মধ্যে। সে কখনওই তার স্ত্রীকে মা হওয়ার স্বাদ দিতে পারবেনা। শারীরিক কোন এক দুর্বলতা তাকে অক্ষম করে দিয়েছে।
এজন্য প্রতিনিয়ত শাস্তি পাচ্ছে সে। আর অন্য একটি মেয়ের সাজানো- গোছানে সংসার তছনছ করার উত্তম শাস্তি যথাযথ ভাবে পাচ্ছে তার বর্তমান কু- চক্রী স্ত্রী। একেই বলে স্রষ্টার খেলা।
হঠাৎ সেই কলরব থেমে যেতেই থমকে তাকালো পুষ্প। একমনে কল্পনা করা বিচ্ছিন্ন ভাবনাগুলো তাকে ছেড়ে গেলো। দেখলো পড়ার সময় শেষ হতেই বাচ্চাকাচ্চাগুলো দৌড়ে আসছে তারকাছে। মুখে সবার অনিন্দ্য হাসি। সেদিকে চেয়ে পুষ্পের মন ভরে উঠলো অনাবিল খুশীতে।
মহান আল্লাহকাউকে নিরাশ করেন না। পুষ্প যখন স্বামি সংসার এমন কি সন্তান সুখ থেকে বঞ্চিত হয়ে কষ্টের অন্ধকারে ডুবে দিক হাতড়ে বেড়াচ্ছিল, তখন এই মহতী উদ্যোগ তার জীবনের গতিপথ বদলে দিল। তার মনের আকাশ আর দুঃখের কালো মেঘে ছেয়ে থাকে না, বরং ছোট ছোট নিষ্পাপ শিশুদের হাসি আর কলরবে তার পৃথিবী টা খুশীর আলোয় ঝলমল করে সবমসময়।
নাইবা বাঁধলো নিজেকে আর সংসারের মায়ায়, পুষ্প তার চেয়ে বড় মায়ার বাঁধনে বাধা পড়েছে। তার প্রতিটা ভোর প্রতিটা দিন শুরু হয় নিষ্পাপ শিশুদের কলতানে। তাদের মায়াময় মুখচ্ছবি পুষ্পের হৃদয়ে সুখের ঝর্না ধারা বইয়ে দেয়।