পর্দা এবং কিছুকথা

পর্দা এবং কিছুকথাপর্দা এবং কিছুকথা
ডি এইচ শিশির

‘এই মেয়ে, উঠে দাঁড়াও। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমটিকে যে ধর্মশালা বানিয়ে ফেলেছ দেখছি!’ – ভার্সিটির প্রথমদিনের ক্লাসে প্রথমসারীর একটি বেঞ্চের মাঝামাঝিতে বসা একটি হিজাব আবৃত মেয়েকে লক্ষ করে বললেন ইংলিশের প্রফেসর মিসেস নিরুপমা। উনি নারীবাদী আন্দোলনের একজন প্রভাবশালী নেত্রী।
মেয়েটি উঠে দাঁড়ালো। তার দৃষ্টি অবনমিত। ম্যাম একটু শক্ত কণ্ঠে তাকে বললেন,- ‘এই মেয়ে, মুখ থেকে পর্দা সরিয়ে দাও। স্মার্ট, যুগোপযোগী হয়ে চলতে শেখ। পৃথিবী যখন দুর্দান্ত গতিতে ছুটছে; বিস্ময়কর সব সম্ভাবনাগুলোকে আলিঙ্গন করে এগিয়ে চলছে তখনও তোমরা নিজেদেকে আবদ্ধ করে রেখেছ প্রাচীন সংস্কৃতিচর্চায়!’

‘দুঃখিত ম্যাম, ‘মেয়েটি বলল, ক্ষমা করবেন। যদি নিজেকে পর্দায় আবৃতকরণ আনস্মার্টনেস হয় তবে আমি আনস্মার্ট হতেই কমফোর্টেবল ফিল করব। দয়াকরে আমাকে বেপর্দা হতে বলবেন না। আর পর্দা কখনোই প্রাচীন সংস্কৃতিচর্চা নয় বরং বর্তমানে চারিদিকে স্মার্টনেসের নামে অতিপ্রাচীনকালের মতো ছোট্টছোট্ট পোশাক পরা হচ্ছে। আর এই নব্যপ্রাচীন সভ্যতার মাঝে পর্দাপ্রথার মতো সুন্দর সংস্কৃতিচর্চা করাও একটা স্মার্টনেস, যা ধারণ করে থাকাকালীন সময়টা অনুভূত হয় এক পবিত্র জান্নাতি প্রশান্তি।’

মেয়েটির জবাব শুনে ম্যাডাম একটু ক্ষেপে গেলেন, ভ্রুকুটি করে বললেন,- ‘কি ব্যাপার, সাধারণ ভদ্রতা ও কি শেখনি? তোমাদের মতো ক্ষ্যাত ছেলেমেয়ে এমন সুনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাও কেমন করে তা আমার মাথায় আসেনা। যাইহোক, কোন ডিপার্টমেন্টে পড়?’

– ‘ফিজিক্সের স্টুডেন্ট। সাইন্স বিভাগে পড়ি।’ খুবই নমনীয় কণ্ঠে উত্তর দিল মেয়েটি। উত্তর শুনে ম্যাডামের মুখেরভঙ্গি কিছুটা পরিবর্তন হয়ে গেলো। মুখে ভেসে উঠল একরাশ কৌতূহল। বললেন,- ‘কী! সাইন্স বিভাগে পড় অথচ এতটা আনস্মার্ট! হাউ ডাউনফল!’

‘ম্যাম, ও এবার ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে। এমন সাজে সজ্জিত হয়ে ক্লাসে আসলেও ও কিন্তু মোটেও আনস্মার্ট নয় বরং প্রাকটিসিং মুসলিম তরুণী।’ পিছনের বেঞ্চ থেকে একজন মেয়ে বলে উঠলো।

ম্যামের মুখের ভঙ্গিমা কিছুটা পরিবর্তন হলো। উনি কয়েকমুহূর্ত সময় নিলেন। তারপর বললেন,- ‘আমার কথায় কিছু মনে করনা। দেখ, তোমাদের মতো জিনিয়াসদেরকে সাথে নিয়ে আমরা নারীবিজিত একটি সুন্দর সমাজ, দেশ, অতঃপর একটি সুখ- শান্তি সমৃদ্ধ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি। যেখানে থাকবেনা কোনো অত্যাচার, অনাচার। যেখানে প্রতিটি নারী তাদের অমূল্যসম্পদ সম্ভ্রম নিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে পারবে। কেউ তাদেরকে শুধুমাত্র ঝি চাকরানী ভাবার অবকাশ পাবেনা। প্রতিটি নারী তার অধিকার ফিরে পাবে। যেখানে চলার পথে কেউ তার ওড়না ধরে টান দেবার, তাকে হয়রাণী করার, তাকে দেখে জিহ্বায় জল আনার সাহস করবেনা। বরং তাদেরকে সম্মান দেখাতেই সদা ব্যস্ত থাকবে।’ ম্যাডাম একটু থামলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তারপর শুরু করলেন। – ‘আমরা স্বপ্ন দেখছি তোমাদেরকে নিয়ে আর সেই তোমরা যদি নিজেদের এভাবে ফ্যাসিবাদী, মৌলবাদী সাজে সজ্জিত কর তাহলে আমাদের এতসব আন্দোলন, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, করে কী লাভ হবে? বল, আমাদের এতো চেষ্টা কাদের জন্য?’

– ‘ম্যাম, ক্ষমা করবেন। আপনারা যার জন্য আন্দোলন, মানোববন্ধন, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম আর বক্তৃতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে সমানাধিকার দাবী করছেন তা নিছক প্রহেলিকা। যা অনেকেই জানে না, বুঝে না। আচ্ছা ম্যাম, যদি অভদ্রতা মনে না করেন তবে একটা প্রশ্ন করি?’
বিনয়াবনত কণ্ঠে বলল মেয়েটি। তারকথা শুনে ম্যামের মনের অবস্থা বিরূপ ধারণ করেছে তা বোঝাই যাচ্ছে। ক্লাসভর্তি স্টুডেন্টসদের চাহনিতে প্রকাশ পাচ্ছে যে তারা খুব মজা পাচ্ছে ছাত্রী এবং অধ্যাপিকার মাঝে একটি স্পর্শকাতর বিষয়ের বিতর্কে। ম্যাম মেয়েটির চোখের দিকে একবার দৃষ্টি ফেলে আবার নামিয়ে নিলেন। দৃঢ়কায়ে মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ সূচক জবাব দিলেন।

মেয়েটি বলল,- ‘শ্রদ্ধেয় ম্যাম, অন্যদের কথা ছাড়ুন, ব্যক্তিগতভাবে আপনি নিজে কি চান যে সত্যিকারার্থেই নারীকুল তাদের মর্যাদা ফিরেপাক? আপনি কি মন থেকেই কামনা করেন যে রাস্তায় বের হলে একটি মেয়েকে উত্যক্ত নয় যুবকরা সসম্মানে তাকে পথচলতে সাহায্য করুক?’

– ‘হোয়্যাট! কি বলতে চাও তুমি?’
বাম হাত দিয়ে চোখ থেকে চশমাটা খুলতে খুলতে উত্তেজিতস্বরে প্রশ্ন করলেন।

– ‘দুঃখিত ম্যাম! আমার একথা বলার কারণ হলো এখনকার অধিকাংশ শিক্ষিতা মহিলাগণ নারীবাদী সংগঠনে যুক্ত হয়ে সিমিলার রাইটস- এর জন্য আন্দোলন করাটিকে ফ্যাশন মনে করেন। বর্তমানে এসবের মাধ্যমে নিজেদেরকে যুগোপযোগী মনেকরা হয়। মনেকরা হয় স্মার্ট। কিন্তু আপসোস! তাদেরকে সুকৌশলে যে ঘর থেকে বের করে এনে এক ভয়াবহতম গোনাহের কাজে সামীল করানো হচ্ছে তা আমার হতভাগ্য জাতি বুঝতে ও দেখতে পারছে না! যেন চোখে রঙিন স্বপ্ন দিয়ে তৈরি ঝলমলে পর্দাটেনে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তবুও এভাবে কখনোই আপনাদের লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়।’

থামলো মেয়েটি। পুরোক্লাস জুড়ে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। মনে হচ্ছে তারা উৎসুক হয়ে একমনে শুনছে কথাগুলো। ওর শেষ কয়েকটা কথা হয়ত ম্যামের মনে ধরেছে। একে তো মুসলিম পরিবারের মেয়ে তার উপর অসামান্য মেধাবী তাই কথাগুলোর মর্মার্থ অতি অল্পতেই আঁচ করতে পেরেছেন।
হয়ত সেজন্য উনি কণ্ঠটাকে একটু নরম করে জানার ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলেন,- ‘তাহলে তোমার কথানুযায়ী এমন বিকল্প পথ থাকতে হবে বা আছে যা দ্বারা মহিলাদের এমন আন্দোলন, সেমিনার, আলোচনা সভা, মানোববন্ধন কিছুই করা লাগবে না তারপরও তারা তাদের অধিকার ফিরে পেতে পারে। আমি ঠিক বলছি?’

– ‘জি ম্যাম, একদম ঠিক বলেছেন।’ -মেয়েটা বলল।

– ‘তাই? গুড। আমি অবশ্যই তা জানতে চাইব কিন্তু বিতর্কের স্টার্টিং অনুযায়ী তুমি উপরন্তু যে বিষয়টি প্রুফ করতে চাও তার সাথে তোমার হিজাব আবৃতকরণের সংশ্লিষ্টতা থাকতে হবে। মানে তোমার মূলবক্তব্যের সাথে অবশ্যই হিজাবের বিষয়টিও মিলিত হতে হবে যৌক্তিকতায় সংঘর্ষহীনভাবে। কারণ মেয়েরা যদি বাইরে বের হয় আন্দোলন করে তবে তো পর্দাপ্রথার সাথে কিছুটা হলেও কম্প্রোমাইজ করতেই হবে। কিন্তু আমি যতটুকু জানি ইসলামের বিধান তো কম্প্রোমাইজেবল নয়। সরল রেখার মতো একটাই পথ, একটাই মত।’

ম্যাম থামলেন। তারপর ক্লাসের অন্যান্য সকল স্টুডেন্টসদের দিকে তাকিয়ে মুখে একফোঁটা হাসির রেখাটেনে বললেন, -‘ডিয়ার স্টুডেন্টস, তোমরা দেখতেই পারছো যে এই মুহূর্তে আমরা একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে ডিবেটিং এর অমীমাংসিত পর্যায়ে রয়েছি। আশাকরি তোমরাও অ্যাটেন্টিভলি শুনবে, সবকিছু বোঝার চেষ্টা করবে। ‘হ্যাঁ, ‘ম্যাম সেই মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি বল এবার। আমি যা বললাম সেবিষয়ে তোমার মতামত এবং যুক্তি উপস্থাপন কর।’

– ‘প্রথমেই বলে রাখি প্রিয় ম্যাম, আমি আপনাকে অকুণ্ঠ সম্মান এবং শ্রদ্ধা করি। আপনার মতো শিক্ষানুরাগী মানুষের সাথে ডিবেট করার মতো জ্ঞান এবং সক্ষমতা কোনোটিই আমি রাখিনা। তাই এই তুচ্ছজ্ঞান নিয়ে এমন দুঃসাহসিক অভিসন্ধিও করছিনা।
শুধুমাত্র জীবন পরিচালনা করার জন্য অপরিহার্য প্রয়োজনীয় এমন কতগুলো বিষয় আছে যা আমাদের অজ্ঞতার কারণে মিসিং রয়েছে।
তা রাসূল (সাঃ) এর বাণী- ”প্রচার কর, যদি একটিমাত্র আয়াতও কেনে থাকো।”- কথাটির পরিপেক্ষিতে পূর্বে আলোচ্য বিষয়টি সামনে আনার অভিপ্রায়ে আমার সম্মানিতা বোনেদের নির্দেশনামূলক কিছু বলার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করছি।’
ম্যাম মাথাটা ঈষৎ কাত করে ‘অনুমতি’ সূচক ইংগিত করলেন। উনি মেয়েটির বিনয়পূর্বক ব্যবহারে রীতিমতো মুগ্ধ। মেয়েটি শুরু করল।

– ‘প্রিয় উপস্থিতি, আমরা সাধারণত যেটা দেখে থাকি যে আমাদের দেশে বর্তমানে অসংখ্য নারীবাদী সংগঠন গড়ে উঠেছে। সবারই মূলনীতি প্রায় একই। শ্রেণী- বর্ণ নির্বিশেষে নারীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে তারা জনমত গঠন করতে সচেষ্ট। সেজন্য এখানে- ওখানে আলোচনা- আন্দোলন, সভা- সেমিনারও করা হচ্ছে কিন্তু অ্যাজ এ রেজাল্ট আমরা কী পেয়েছি?
অন্তত বাংলাদেশকে আপনারা পুরুষশাসিত বলতে পারেন না কারণ আমি জন্ম থেকেই দেখে আসছি এদেশে বারংবার প্রধানমন্ত্রী হন দুজন মহিলা। মন্ত্রীসভাও আলোকিত করে আছেন আরও কয়েকজন নারী। এছাড়াও স্পিকার থেকে শুরুকরে জাতীয় সংসদ সদস্য, ডিসি, এসপি, ইউ এন ও, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউ পি চেয়ারম্যান এবং ইউ পি সদস্য এসবক্ষেত্রে আছে নারীদের সাফল্যপূর্ণ বিচরণ। এর অর্থ পুরো দেশের পাওয়ার অফ কন্ট্রোল নারীদের হাতে। ঠিক বলছি তো?’

প্রশ্ন করে একবার শ্রোতাদের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো মেয়েটি। তারপর তাদের মুগ্ধ দৃষ্টি আর অখণ্ড নীরবতায় প্রমাণ করল সবাই পূর্ণসমর্থন করছে। একটু দম নিয়ে ও আবার বলতে আরম্ভ করল, ‘তাহলে বলা যায় অন্ততপক্ষে একারণে হলেও বাংলাদেশের নারীজাতির মুখে পুরুষ কর্তৃক নির্যাতনের কথা মানায় না। অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে যৌক্তিক বিচারে একথা বলা যায় যে, বাংলাদেশ আজ পুরুষ নির্যাতনের শীর্ষ দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিত হবার কথা।’
কথা শেষ হতেই ক্লাসের ছেলেমেয়েরা সশব্দে তালি দিয়ে উঠল। ক্লাসজুড়ে হাসির রোল পড়ে গেল। ম্যাম সবাইকে থামতে বলে ইংগিত করে বললেন,- ‘প্লিজ, বি কন্টিনিউ মাই গার্ল!’
মেয়েটি আবার বলতে আরম্ভ করল।

– ‘আমার উপরন্তু কথাগুলো দ্বারা এই বিষয়েরই প্রামাণ্যচিত্র উপস্থাপন করতে চেয়েছি যে, যেখানে একটি দেশের চেইন অফ কমাণ্ড নারীদের হাতে থাকার পরও তাদের ভাগ্য উন্নয়ন হলো না সেখানে এসব নারীবাদী আন্দোলন পরিকল্পিতভাবে পশ্চিমাদের সুক্ষ্মমেধায় রচিত ঈমান, ধর্মীয় মূল্যবোধ, নীতি নৈতিকতা বিধ্বংসী ফ্যশন শো ছাড়া আর কিছুই নয়।

এভাবে নারীদের অধিকার আদায় করার চিন্তা আর গাছের গোঁড়া কেঁটে আগায় সযত্নে পানি ঢেলে গাছ থেকে সুস্বাদু ফল পাওয়ার আশাকরা একই কথা।’

‘কি! ‘ম্যাম বললেন, ‘এর দ্বারা তুমি কি বোঝাতে চাইছ?’
মেয়েটি বলল,- ‘একথার দ্বারা উদ্দেশ্য সেসমস্ত মা বাবা, শিক্ষক, এবং সর্বশ্রেণীর অভিভাবকদের সচেতন করা যারা আশাকরেন তাদের ছেলেমেয়েরা তাদেরকে সম্মান, শ্রদ্ধা, মান্য করবে কিন্তু সেগুলো শেখার যে প্রসেসিং আছে তা তারা নিজেরা তো ব্যক্তিগত জীবনে চর্চা করেনই না আবার তাদের সন্তান, ছাত্র ছাত্রীদেরকেও তা করতে শেখায় না; বরং যারা প্রাকটিসিং হতে চেষ্টা করে উনারা তাদের ঘোর বিরোধীতা ও নিরুৎসাহীত করেন। বলুন, তাহলে কিভাবে সম্ভব অধিকার ফিরে পাওয়া?

আজ সমস্ত নৈতিক অবক্ষয়ের মূলে রয়েছে আমাদের বাবা মা, শিক্ষক শিক্ষিকাগণের ব্যর্থতা। আর আপনারা ব্যর্থ বলেই যেমন নিজেদেরকে প্রাপ্য সম্মান, মর্যাদা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত রেখেছেন তেমনি আমাদেরও সম্মান প্রদর্শন করার মতো মহত্তম কাজ করা থেকে বঞ্চিত করেছেন। আজ একটি বৃহত্তম ইসলামি রাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবি হয়ে আপনারা এদেশকে সম্মান, মর্যাদা, আর প্রতিপত্তির সুউচ্চ চূড়ায় সমাসীন করতে, মডেল রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে কমিউনিজম, আগ্রাসী সোশিয়ালিজমের খোঁজ করেন অথচ যেই অনুপম জীবনবিধানও শাশ্বত ধর্মের আলো ছায়া, সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠেছেন তাকেই ভুলে গেলেন অবলীলায়।

নবুয়ত প্রাপ্তির মাত্র ২৩ বছরের মধ্যে ধুঁ ধুঁ মরুভূমির অজ্ঞ, পাপ পঙ্কিলতায় ডুবে থাকা মানুষগুলির অন্তরে হেদায়াতের নূরশিখা জ্বেলে, স্রষ্টব্য সভ্যতার ঘ্রাণে সুশোভিত করে তাদেরকে সাথে নিয়ে মহানবী (স) সমগ্র আরব ভূখণ্ড জয়করে এমন একটি রাষ্ট্রগঠন করেন যে রাষ্ট্রে শুধু মুসলিমজাতি নয় অমুসলিম নাগরিকরাও পূর্ণ অধিকার নিয়ে সুখে শান্তিতে, স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করত। গভীররাত্রিতেও একাকিনী রমণী আপন গন্তব্যে পৌঁছে যেত নির্বিঘ্নে। একটা সময় বিশাল একেকটি প্রদেশেজুড়ে জাকাত নেওয়ার মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া যেতো না। ভাবুন, মাত্র একযুগ আগেও যে দেশটির প্রথা ছিল নারী মাত্রই অভিশাপ মনে করা, জীবন্ত কন্যা সমাহিত করা, নিজের মা, সৎ মা’কে বিবাহ করা। এক কথায় সেসময় তারা নারীদের শুধুমাত্র ভোগের সামগ্রী মনে করত। অথচ মাত্র একযুগ অতিক্রম করার সাথে সাথে সেই প্রথা পদদলিত হতে শুরু করল এবং দুইযুগের মধ্যে তা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেল। কি আশ্চর্যকথা! যে বা যারা এইতো মাত্র কিছুদিন আগেও নারীদের ভোগের সামগ্রী মনে করত কন্যা সন্তান পাথরচাপা দিয়ে জীবন্ত হত্যা করত তারা অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে তাদেরকেই জান্নাতকে পায়ের নিচে রাখা এক অতুলনীয় মর্যাদার অধিকারী হিসেবে সম্মান করতে লাগলো! কি এক স্বপ্নিল পরিবর্তন ঘটে গেলো, তাই না? হ্যাঁ, এমন অনন্য রেনেসাঁ এর আগে ও পরে কখনোই ঘটেনি এবং ঘটবে না। ঠিক এজন্য রাসূল (স) এবং খোলাফায়ে রাশেদিনএর শাসিত সেই সময়টা স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে বিশেষ স্থান দখল করে আছে এনসাইক্লোপিডিয়ার রেকর্ডসে।’

থামল মেয়েটি। একনাগাড়ে কথা বলার পর একটু শ্বাস ফেলতে হয়ত। ।
ক্লাসজুড়ে নিঃসীম নীরবতা । মুসলিম ছেলেমেয়েদের চোখে মুগ্ধতা ফুঁটে উঠেছে।
আর অন্যান্য ধর্মালম্বীদের চাহনিতে ফুঁটে উঠেছে নিরুপম বিস্ময়।
একটু দম নিয়ে ও বলল,
‘স্বয়ং মহান আল্লাহ্ তায়ালা মহাগ্রন্থ আল কোরআনুল কারীমের সূরা আহযাবের ৫৯ নং আয়াতের মধ্যে বলেছেন,
– “হে নবী! তোমার স্ত্রীদের, কন্যাদের ও মু’মিনদের নারীদেরকে বলে দাও তারা যেন তাদের চাদরের প্রান্ত তাদের ওপর টেনে নেয়। এটি অধিকতর উপযোগী পদ্ধতি, যাতে তাদেরকে চিনে নেয়া যায় এবং কষ্ট না দেয়া হয়। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও করুণাময়”

এবার মূল কথায় ফিরে আসি। সম্মানিতা ম্যাম, আপনিই বলুন যেই একটিইমাত্র জীবনব্যবস্থা এমন সুষ্ঠু, সুন্দর, নিরপেক্ষভাবে নিঁখুত নির্দেশনা দিয়েছে যা অনুসরণ; জীবনে বাস্তবায়ন করলেই শুধুমাত্র বিশ্বজুড়ে শান্তির অমিয় ধারা বইয়ে দেওয়া সম্ভব, আমরা তাকেই যদি এড়িয়ে কৃত্রিমতায় সুখ, শান্তি, অধিকার খুঁজতে চাই তবে কি তা আদৌ ফলপ্রসূ হবে, বলুন? হবেনা। আর পর্দা এমন একটি চর্চা যা আবৃত করলে আল্লাহ্‌ তায়ালা সম্মান বৃদ্ধি করে দেন। যার বাস্তব উদাহরণ আমি নিজেই। পর্দা আবৃত থাকার কারণেই আমি কখনো পথেঘাটে মানুষের দ্বারা উত্যক্ত হইনা বরং আল্লাহু সুবহানাহুয়া তায়ালার রহমতে প্রতিটি পদেপদে অফুরান সম্মান পেয়েছি; যদিও কিছু মানুষ ভ্রুকুঞ্চন করত, কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ্‌! তা আমাকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি ।

ম্যাম, আপনাদের সংগঠনের সবচাইতে বড় দাবী এবং আলোচিত বড় ইস্যু হলো ‘সমান অধিকার ‘ অথচ ইসলাম কী বলছে দেখুন, “হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণীত তিনি বলেন, একদা জনৈক ব্যক্তি রাসূল (স) এর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার কাছ থেকে বেশি খেদমত পাবার হক্কদ্বার কে? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার বাবা।”

ইসলাম বলে, একজন নারীকে ‘মা’ হিসেবে একজন পুরুষের থেকে তিনগুণ বেশি মর্যাদা দাণ করা হয়েছে (সুবহানআল্লাহ্)!
ক্লাসের সকল মুসলিম ছেলেমেয়ে একযোগে বলে উঠল, ‘সুবহানআল্লাহ্!’

থামলো মেয়েটি। পুরোক্লাস থমথমে। কারও কারও নির্লিপ্ত চোখ যেন ছলছল করছে। ধর্মীয় স্বর্ণজ্জ্বল ইতিহাসের পাতা থেকে ব্যক্ত করা হৃদয় শীতল করা কথাগুলো তাদের অনুভূতিকে সজীব করে তুলছে। মলিন হয়ে আছে ম্যামের মুখখানা । উনি উঠে দাঁড়ালেন। মমতা মেশানো ছলছল দৃষ্টিতে একবার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন তারপর অস্ফুটস্বরে কিছু একটা বলতে বলতে বের হয়ে গেলেন; কথাগুলো ছিলো কিছুটা এমন, ‘.. আবার নতুন করে সব ভাবতে হবে।’

Share with Friends

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top