গল্প: দানশীল – ডি এইচ শিশির

দানশীল

দোস্ত, প্লিজ আর ‘না’ বলিস না। একটু ভালভাবে বুঝতে চেষ্টা কর, তোর শরীর থেকে মাত্র একব্যাগ রক্ত দিলে তোর কোনো ক্ষতি হবে না, বরং বেঁচে যেতে পারে একটি প্রাণ। তোর একব্যাগ রক্তের বদৌলতে শুধুই একটা দেহে প্রাণের নব স্ফুরণই ঘটবে না; দুটি ছোট্টছোট্ট ছেলে- মেয়ে আবার তাদের প্রাণের স্পন্দন বাবাকে বাবা বলে ডাকতে পারবে। একটুকরো কোমল আদরের খোঁজে হয়ত আবার ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে বাবা নামক অঠেয় ভালোবাসার মানুষটার বুকে। স্রষ্টা চাইলে একটি পরিবারের উপর ধেয়ে আসা কালো মেঘের অবকীর্ণতা হয়ত আরও কিছু দিনের জন্য দূরে সরে যাবে। কারও মুখে একফোঁটা স্বস্তির নির্মল হাসির কারণ হবার চাইতে মহত্তম সুখ কি আর পৃথিবীতে থাকতে পারে, বল? মানুষ তো মানুষেরই জন্য, আর জীবন আরেকটি জীবনের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসার জন্য।

বন্ধু, যে জীবন সুযোগ, আর অপরের প্রয়োজনে পাশে থাকার সামর্থ্য থাকার পরও কারও উপকারে না আসতে পারে সে জীবন যে নির্জীবতার অপর নাম। এমন অর্থহীন জীবন সত্যিকারার্থে পৃথিবীর বোঝা।
আচ্ছা একটু ভাব, এমন যদি হত, আজ ঠিক এসময় তোর কোনো প্রিয়জন এমন অবস্থায় থাকত যে, একব্যাগ; মাত্র একব্যাগ রক্তের জন্য জীবন- মৃত্যুর মাঝপথে এসে থেমে আছে মানুষটি! হ্যাঁ, তোর প্রিয়জন সেই অসুস্থ মানুষটির কথাই বলছি যার চোখ দুটিতে লেগে আছে আরও একটি দিন বেঁচে থাকার প্রবল আকাঙ্খা। যখন আরও কতক মুহূর্ত প্রিয়জনদের সাথে কাটানোর তীব্রতর আকাঙ্খা নিয়ে পথ চেয়ে আছেন তিনি, তখন রক্ত, মাত্র একব্যাগ রক্ত হয়ে দাঁড়াল তাঁর জীবন- মৃত্যুপথের একমাত্র অন্তরায়। তখন তার ঝাপসা চোখদুটি সমগ্র পৃথিবীর ছয়’শ কোটি মানুষের মাঝে একটি মানুষকে খুঁজে ফিরবে যে তার শরীরের সবচাইতে স্পর্শকাতর জিনিশটি দিয়ে তাকে সুস্থ, সুন্দর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ দিবে। দিবে নতুন দিনের হাতছানির বাস্তব স্বপ্ন।

প্রিয়বন্ধু, দোআ, প্রার্থনা আর শুভকামনা তো সবাই করতে পারে। মুচি থেকে সমাজপতি, পতিতা থেকে দেশনেত্রী সর্বোস্তরের মানুষ ফ্রীতে দোআ নামক বুলি আওড়াতে পারে। কিন্তু, এদের মধ্যে যে সামান্য প্রত্যক্ষ সাহায্যটুকু করতে এগিয়ে আসতে পারবে সেই হলো প্রকৃত মানুষ। সহস্র মানুষের মাঝে মহত্তম মানুষ।

আর একটি কথা, উপকারীর উপকারের প্রতিদান স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা উত্তমরূপে দিয়ে থাকেন। কখন, কিভাবে, কার মাধ্যমে তা পৌঁছাবে সেটি সবারই অজানা।

ইতি
জাহিদ’

সময়টা বেশ কয়েকবছর আগের। সেদিন আমার বন্ধু জাহিদের ছোট চাচ্চু অসুস্থ ছিল। ভীষণ অসুস্থ। চারিদিকে রক্ত খুঁজেও দুর্লভ গ্রুপের রক্ত কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না। পাওয়া গেলেও শারীরিকভাবে রক্ত ডোনেট করার সামর্থ্য হচ্ছিল না অনেকের। তাই জাহিদ জোর করে আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল হসপিটালে। বলেছিল যদি আমি না দিতে চাই তবে ও জোর করবেনা। কিন্তু আমার সবকিছু পরীক্ষা করার পর যখন আমি পার্ফেক্ট হলাম তখন সে তার কথা রাখেনি। ক্ষুধার্ত মানুষ যেমন খাবার দেখলে খাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে তেমনি ও এবং হসপিটালের সবাই আমাকে রক্ত ডোনেট করতে অনুরোধ করতে থাকে। বলতে থাকে অনেকরকম অভয়বাক্য। কিন্তু আমি ছিলাম ভীষণ ভিতু। গায়ের মধ্যে সুচ ফোঁটানোতে ছিল আমার বেশি হয়। ভীতিবিহ্বল হয়ে পড়ছিলাম রক্ত দেবার মোটা সিরিঞ্জ হাতের মধ্যে ঢুকানোর কথা ভাবতেই।

তাই আমি আমার কথাতেই অনড় যে রক্ত আমি দিবই না। সে যাইঘটুক না কেন। আর মাথার মধ্যে রাগতকণ্ঠে বারবার বেজে উঠছিল, ‘রক্ত আমি কেন দিব? জাহিদ ওর কথা রাখেনি। ও তো বলেছিল আমাকে কোনো অনুরোধ করবেনা জাস্ট চেস্ট করবে। কিন্তু তবুও ও সবার মাঝে আমাকে এমন বিব্রত করল! আর ওর আত্মীয়গুলোও হয়েছে তেমন। একটু নাদুসনুদুস দেখেছে অমনি রক্ত চাওয়া আরম্ভ করছে। আমি ভার্সিটি পড়ুয়া ছোট্ট একটা ছেলে তা তাদের নজরে আসছেনা! হুর!’ আমি আদৌ তখন ছোট্ট ছিলাম কিনা জানিনা তবে আমি যখন ভিতরথেকে রেগে ফুঁসছিলাম ততক্ষণে
অসংখ্যবার আমাকে রিকুয়েস্ট করার পর সবাই আশা ছেড়ে দিয়েছে। কেউ সাহায্য পাওয়ার নতুন চিন্তা করছে আবার কেউ কেউ অনিচ্ছা সত্ত্বেও অসহনীয় সত্যের অপেক্ষা করছিলো। ছেড়ে দিয়েছিলো আল্লাহ্‌ তায়ালার হাতে। তখন হঠাৎ খেয়াল করলাম সবার মাঝ থেকে জাহিদ উধাও হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর ও ফিরল আর আমার হাতে একটুকরো চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে আশাহত কণ্ঠে বলল, ‘তোর উপর অবিচার করে ফেলেছি বন্ধু, পারলে ক্ষমাকরে দিস। আর তোর যা ভাল মনে হয় করিস!’

সেদিন ওর লেখা চিরকুট পড়ার পর কেন যেন সম্মোহিতের মতো রক্ত দিয়েছিলাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে গায়ে সুচফুঁটানোর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত আমি ওকে মনে মনে গালি দিয়েছিলাম। কিন্তু যখন রক্ত দেহচ্যূত হয়ে বেরহতে শুরু করেছিল তখন মনে হচ্ছিল মন থেকে সকল ভয়, জড়তা, হতাশা আর কষ্টগুলো প্রবাহিত রক্তকণার সাথে বের হয়ে যাচ্ছিল। বদৌলতে সেই শূন্যস্থান পূর্ণ হচ্ছিলো অবর্ণনীয় খুশি আর বাঁধ ভাঙা আনন্দে। কাউকে রক্ত দাণ করার মধ্যে যে কতটা আনন্দ থাকে তা অনুভূত হচ্ছিল। সেই শিহরণ ছড়িয়ে পড়ছিল শরীরস্থ প্রতিটি তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে।

আমি শিশির। আজ যখন আমার আম্মা অসুস্থতার জন্য দু’ব্যাগ রক্ত প্রয়োজন ছিলো, যার মধ্যে একব্যাগ এতোটাই ইমার্জেন্সি ছিলো যে, অল্প কিছুসময়ের মধ্যে তা সংগ্রহ করতে না পারলে তাঁর জীবন বিপন্ন হয়ে দাঁড়াতে চলছে। আমার চোখের সামনে প্রাণাধিক প্রিয় জননী শুয়ে আছেন। তাঁর চোখদুটি হসপিটালের ইমার্জেন্সি রুমের সাদারঙা সিলিং- এর দিকে নিবদ্ধ। হয়ত মন জুড়েও তাঁর তোলপাড় করছে আরও কিছু মুহূর্ত বেঁচে থেকে আমাদের মুখগুলো দেখার উৎকণ্ঠা, আকুতি। হয়ত সেজন্যই নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাঁর খেলা করছে চাপা উত্তেজনা। তাঁর নিস্তব্ধ নীরবতা আমাকে বিদ্ধ করছে আমি হসপিটালের করিডোরে ছটফট করে পায়চারি করছি। মাত্র একটা ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করতে পারলাম না মায়ের জন্য!একদম নিরুপায়, অপদার্থ মনে হচ্ছে নিজেকে।

এভাবে আত্মসমালচনা করছি ঠিক তখন হঠাৎ করেই মনে পড়ল সেদিনের কথা। জাহিদের চিরকুটে লেখা কথাগুলো হুবহু ভেসে উঠল চোখের সামনে মনের আয়নায়। কঠিন এক শ্বাসরুদ্ধকর বাস্তবতার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আমি সত্যই আজ রিয়ালাইজ করতে পারছি কেন সেদিন জাহিদ সহ সবাই এতোবার অনুরোধ করছিলো আমাকে। কেন আমি ‘না’ করার পরও বারবার জাহিদ ছুটে আসছিলো আর আমাকে কনভেন্স করার বৃথাচেষ্টা করে যাচ্ছিলো। মাত্র একব্যাগ রক্তের জন্য আপন স্বজনের অনন্ত জগতে পাড়ি জমানোর মতো বোঝা কেউ বইতে পারেনা। মেনে নিতে পারেনা সহজভাবে। যেমনটা এখন আমার অনুভূত হচ্ছে। প্রিঞ্জরটা বিচ্ছিন্ন হয়ে আসতে চাচ্ছে। মনটা যেন অদৃষ্টের রঙ তুলিতে ছবি আঁকছে শুধু একজন মানুষের আর চোখদুটো খুঁজে ফিরছে তাকে নিঃসীম বাস্তবতায়; যে এই অস্থির মনটাকে আশ্বস্ত করবে । আমার সামর্থ্যের শেষবিন্দু সম্পদের বিনিময়ে হলেও তা মেনে নিব।

এসব সাতপাঁচ ভাবছি তখন জাহিদের শেষোক্ত কয়েকটি কথা মনে পড়ে গেল। মহান আল্লাহ তায়ালা কখন, কিভাবে, কার দ্বারা সাহায্য করবে তা সবারই অজানা। তবে উপকারী তার উপকারের উত্তম প্রতিদান অবশ্যই পেয়ে থাকেন রহমান স্রষ্টার নিকট হতে। কথাগুলো মনে হতেই হঠাৎ নিরাশার চোখে আলোর ঝলকানি নেচে উঠল। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলাম, ‘আমি কেন স্রষ্টার এই রহমত থেকে বঞ্চিত হব? হ্যাঁ, একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই পারেন আমাকে এই কঠিন অবস্থা থেকে মুক্ত করতে করতে।

আম্মার বেডের দিকে তাকালাম। উনি আগের মতই নির্বাক চেয়ে আছেন সিলিং- এর দিকে। আমি হন্তদন্ত হয়ে ছুটলাম হসপিটালস্থ মসজিদ পানে। সুন্দরভাবে অজু করলাম। দু’রাকাত নফল নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে গেলাম। মায়ের আদর, ভালোবাসার সকল স্মৃতি এসে ভর করল স্নায়ুতে। অসুস্থ থাকা অবস্থায় যখন পড়ে থাকতাম তখন মায়ের নিঃস্বার্থভাবে করা শুশ্রূষার কথা মনে পড়ল। নিজের জীবন বিপন্ন করে ঐ মানুষটা আমাকে পৃথিবীতে এনেছেন আজ সেই আমি বেঁচে থাকতেও আম্মার জীবন কত সংকীর্ণ হয়ে এসেছে! আবেগপূর্ণ এক অজানা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল সারা শরীরজুড়ে। সেজদায় গিয়ে কান্না আর আটকে রাখতে পারিনি। জায়নামাজ ভিজে উঠল চোখ থেকে ঝরে পড়া প্রস্রবণ ধারায়। কতক্ষণ পর চোখ মেললাম যখন, তখন দেখলাম আমার শিয়রে দাঁড়িয়ে আছে আমার থেকে কমবয়সী একটা ছেলে। সে আমার কান্নাভেজা নিষ্প্রভ চেহারায় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ । জড়সড় কণ্ঠে সে জানতে চাইলো আমার এই কান্নাকাটি করার কারণ। এও জানাল যে তার এমন নিবিড়ভাবে আল্লাহর সান্নিধ্য নিতে কাউকে সে দেখেনি ইতোপূর্বে। তাই নামাজ শেষ করে অপলকে দেখছে আমাকে। ঠিক সেই মুহূর্তে কষ্টপূর্ণ অনুভূতিগুলো কারও কাছে সেয়ার করতে ছটফট করছিলো আমার অস্থির, অশান্ত মন। তাই তাকে খুলে বললাম সবকথা। আমি বলছিলাম আর সে একমনে শুনছিলো।

মহান আল্লাহ তায়ালার সাহায্য বুঝি এমনই আকস্মিকভাবে আসে! আমার কথা শেষ হতেই সে মুখে একফোঁটা হাসি এঁকে যা বলল, এই মুহূর্তে সে কথাটির চাইতে বেশি খুশির কোনো সংবাদ হতে পারেনা আমার জন্য।
তার রক্তের গ্রুপ আর আম্মার গ্রুপ একই। আর সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রক্ত দিতে চায়। এখন আমার মনে হচ্ছে তার মুখের ঐ হাসিটা আমার দেখা পৃথিবীর সবচাইতে সেরা উপহার। যার প্রতিদান একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই দিতে পারেন।
তাকে নিয়ে পথচলতে শুরু করলাম আম্মার কাছে। হঠাৎ একটি কথা মনে এলো যার সত্যতা আমি নিজে রিয়ালাইজ করলাম।

‘মানুষের সাহায্য সহযোগীতার সর্বচ্চো সীমারেখাও যখন শেষ হয় স্রষ্টব্য সাহায্য তখন থেকেই শুরু হয়। আর দাণ কখনওই বিফল হয় না। ছোট্ট একটা সাহায্য এক পৃথিবীসমান প্রাপ্তি হয়ে কখন, কিভাবে, কার দ্বারা আপনার নিকট ফিরে আসতে পারে তা আপনার ভাবনার ও অতীত। ‘

‘অপরকে দাণ করলে তা নিজের হয়ে ফিরে আসে’ / ডি এইচ শিশির

Share with Friends

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top