গল্প : আলোক পথের অভিযাত্রী, ডি এইচ শিশির

সম্পূর্ণ ‘আল-কোরআনের লজিক’ এবং তা আধুনিক বিজ্ঞানের রেফারেন্সে রচিত

গল্প : আলোক পথের অভিযাত্রী (বই মেলা ২০১৮)

অপরাহ্ণের প্রথম প্রহর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে আসরের নামাজের পরে প্রতি জুম্মাবারের ন্যায় আজও শিশির তার পছন্দের মানুষ, প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবর জেয়ারত করে অবনত মস্তকে আল্লাহ্ তায়ালার কাছে দু’হাত তুলে প্রার্থনা করলো উনাকে জান্নাতি মানুষ হিসেবে কবুল করে নেওয়ার জন্য। তারপর নিজেকেও তাঁর মতো একজন মহান, খোদাভীরু, আর জ্ঞানি মানুষ হওয়ার মতো তাউফিক কামনা করে মোনাজাত সমাপ্ত করল। এরপর সেখান থেকে সোজা পূর্ব দিকের পথ ধরে হাটতে শুরু করল। কিছুদূর আসতেই তাকে একজন ডাক দিলেন-

‘এই যে ছেলে এখানে আসো ।’

শিশির এক পা দুই পা করে এগিয়ে গেলো তার কাছে । দেখল একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক পাশেই একটি বেঞ্চে বসে আছেন। দেখে বেশ সম্ভ্রমশীল মনে হল তার কাছে। উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। তীক্ষ্ণ লোকটির দৃষ্টি- কিন্তু স্পষ্টত কোন বিভ্রান্তি নিয়ে সদা পথ চলা পথিক বলে মনে হল শিশিরের কাছে। শিশির উনার কাছে এসেই নরম কণ্ঠে সালাম দিলো

– ‘আস্সালামু আলাইকুম ।’

লোকটি উত্তর করল কিনা বোঝা গেলনা । কিন্তু চশমাটি খুলে হাতে নিয়ে ফুঁ দিয়ে আবার পরে নিলেন তারপর মাথাটা ঈষৎ উঁচু করে তাকালেন শিশিরের মুখের দিকে। এরপর কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন

– ‘কী নাম তোমার? ‘

– ‘শিশির ।’

– ‘শিশিরস্নাত জোস্না রাতে খালি পায়ে সবুজ ঘাসের উপর একাকী চলা আমার প্রিয় অভ্যাসগুলির মাঝে একটি । তা- যা বলছিলাম, তুমি তো মুসলিম ।
জানো, পৃথিবীতে যতপ্রকার ধর্মীয় বিশ্বাসী জাতী আছে তার মধ্যে একমাত্র মুসলিমদের আচার- ব্যাবহার, নৈতিকতা- মমত্ববোধ, আর অবিকৃত সংস্কৃতিই আমাকে মুগ্ধতা এনে দেই। আমি বহুদেশ, বহু জাতী, বহু সভ্য-অসভ্য মানুষের সাথে মিশেছি । কিন্তু মুসলিম জাতীর কালচারটিকেই আমার কাছে অনুপম, আদর্শ আর বর্ণাঢ্য সাজে সজ্জিত মনে হয়েছে । যদি আমি কখনও কোন ধর্মে বিশ্বাসী হতাম তাহলে নিঃসন্দেহে তা হতো ইসলাম ।’ – এতটুকু বলে তিনি সশব্দে নিঃশ্বাস ফেললেন। তাঁর মুখের গম্ভীরতার মাঝেই এক চিলতে হাসির রশ্মি ফুটে উঠল।
‘তারমানে আপনি নাস্তিক? ‘ – চেহারা স্বাভাবিক রেখেই প্রশ্ন করল শিশির

– ‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছ আমি কোন ধর্মে বিশ্বাসী নই। কোন ধর্মকে বরণ করে নেওয়ার আগে মনে উদয় হওয়া প্রশ্নগুলোর যুক্তিসংগত উত্তর মেলেনি; তাই…।
উনি কথাটা শেষ করলেন না। একটু থেমে আবার বললেন, তা বাবা, তোমাকে যে জন্য ডেকেছি তা হলো তোমার কাছে আমার ছোট্ট তবে গুরুত্ববহ একটা প্রশ্ন আছে । করব?’

– ‘জি করুণ।’ – কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিচের ঠোটে হালকা কামড় দিতে দিতে বলল শিশির। উনিও কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে কিছু একটা ভাবলেন; যেন নিজেকে গুছিয়ে নিলেন। তারপর শুরু করলেন।

– ‘তুমি একটু আগে ঐ সমাধীতে গিয়ে প্রার্থনা করলে বলে মনে হলো । প্রে করার নিয়মটা খুব সুন্দর। নমনীয়তা শৃঙ্খলা আর আধ্যাতিকতার গভীরতা বিদ্যমান ছিল। কিন্তু কেন?
যে নিয়তির খেয়ালে তিনি ধরাতে এসেছিলেন আবার সেই অলঙ্ঘনীয় নিয়মের ধারাবাহীকতাই অবনী ত্যাগ করে অন্যভূবনে পাড়ি জমিয়েছেন । এবং এখন তার সমাধীতে খুঁজলে দেখা যাবে তার হাড় মাংস পঁচে-গলে মাটির সাথে মিশে একাকার হয়ে আছে । আর যে একবার মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করে সে কিভাবে আবার দ্বিতীয়বার জীবিত হবে?
আমরাতো কখনও কাউকে দ্বিতীয় জীবন পেতে দেখিনি।
তাহলে কোন বিশ্বাসে তুমি তার মঙ্গল কামনার্থে অদেখা স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করছ? এটা কি নির্বুদ্ধিতা নয়? আর যাকে উদ্দেশ্যকরে প্রশংসক বুলি প্রেরণ করছ তাঁর (স্রষ্টার) কোন অস্তিত্বের প্রমাণ কী তোমার নিকট আছে?’

কথা গুলো বলে তিনি একটি লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শিশিরের দিকে তাকালেন ।
শিশির কয়েক মুহূর্ত চুপকরে থেকে বলতে আরম্ভ করল

-‘হ্যাঁ, বাইরে থেকে হয়ত স্বাভাবিক দৃষ্টিতে আপনার বক্তব্য সঠিক । কিন্তু সব কিছুর পিছনে স্রষ্টব্য কিছু
রহস্য আছে যা স্বাভাবিক ভাবে আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়না । আর দ্বিতীয় জীবন শুরুহয় আমাদের দৃষ্টির অন্তরালে । জীবিত অবস্থায় তা আমাদের ইন্দ্রীয় স্পর্শ করতে পারেনা ।

এটা বুঝতে, অনুধাবন আর অন্তঃকরণ করতে প্রয়োজন স্রষ্টাতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করা ।
হ্যাঁ, আমি সেই পবিত্র স্রষ্টাতত্ত্ব মহাগ্রন্থ আল-কোরআন থেকেই স্রষ্টা সমন্ধে জেনেছি এবং তাঁর উপর পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপনও করেছি । যেখানে সকল প্রশ্নের যথাযথ উত্তর পূর্ণরূপে বিদ্যমান । আর একটি কথা, আপনাকে জানাতে চাই যে মহান আল্লাহ তায়ালা একথা বলেছেন যে উনি সকল মৃত ব্যক্তিকে শেষ বিচারের দিন পুনরায় জীবিত করবেন এবং প্রত্যেকের পার্ফমেন্সের উপর নির্ভর করে সুষ্ঠু বিচারপূর্বক জান্নাত অথবা জাহান্নামকে তাদের স্থায়ী নিবাস হিসেবে প্রদান করবেন । যে ভালো কাজ করবে তার স্থান হবে চিরস্থায়ী সুখের অবর্ণনীয় স্থান জান্নাত অথবা বিপরীতরূপি শাস্তির অকল্পনীয় স্থান জাহান্নাম প্রদান করবেন । ‘

আর মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনের মধ্যে বলছেন –
”যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদেরকে মৃত মনে করো না। তারা আসলে জীবিত। নিজেদের রবের কাছ থেকে তারা জীবিকা লাভ করছে।”

এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে মৃত্যুর পরেও মানুষ কবরে জীবিত থাকে । এবং তাতে বিন্দু পরিমাণে সন্দেহের অবকাশ নেই । যেহেতু এ সয়ং আল্লাহর বাণী ।
এজন্যই আমরা বিনীত ভাবে কবরবাসীর ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকি ।

শিশির থামল। উনি কিছুটা বিরক্তিপ্রকাশক ভ্রুকুঞ্চন করলেন তারপর বললেন

-‘আচ্ছা একটি বিষয় আমার মাথায় আসছেনা ।
তুমি তো দেশের সর্বচ্চ বিদ্যাপীঠের একজন গর্বিত ছাত্র।
অসম্ভব ট্যালেন্ট না থাকলে শতশত মেধাবীকে পিছনে ফেলে এখানে আসতে পারতেনা ।
কিন্তু বিজ্ঞানের যুগে এসেও তোমরা কিভাবে এমন মিথ্যা, ভিত্তিহীন, খামখেয়ালিপনাগুলো গুলো মেনে নাও?
কেন বুঝতে পারো না যে ১৪০০ বছর আগে একজন মানুষ মনের খুশি মতো যা ইচ্ছা তাই বলে গেছেন । তোমরা আবার সেটিকে স্রষ্টার বাণী বলে মনে কর । কোরআন যে ঐশী বাণী, আসমানি কিতাব তার কোন প্রমাণ কি তোমার কাছে আছে?’

– ‘আঙ্কেল, দেখুন আপনি অনেকগুলো প্রশ্ন করেছেন এবং যে প্রশ্নগুলো করেছেন ‘আলহামদুলিল্লাহ্‌’ তার যথাযথ প্রমাণ উত্তম রূপেই হৃদয়ঙ্গম করার তাউফিক আমার স্রষ্টা আমাকে দিয়েছেন । ইনশাআল্লাহ্ আমি চেষ্টা করব ধারাবাহীকভাবে তা উপস্থাপন করার । আপনার প্রশ্ন হলো –
আল-কোরআন ঐশি গ্রন্থ কি না? ঠিক আছে তো?’ – শিশির প্রশ্ন করলো ।
লোকটি একটু কুণ্ঠিত দৃষ্টিতে তাকালেও মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ সূচক জবাব দিলো । শিশির তখন বলতে শুরু করল

– ‘ঠিক আছে তাহলে চলুন শেষ থেকেই শুরুকরি আর আল্লাহ চাহেত শুরু দিয়েই শেষ করব । মহান আল্লাহ তয়ালা পবিত্র কোরআনুল কারীমের মধ্যে বলেছেন যে-

‘আর এ কুরআন আল্লাহর অহী ও শিক্ষা ছাড়া রচনা করা যায় না। বরং এ হচ্ছে যা কিছু আগে এসেছিল তার সত্যায়ন এবং আল কিতাবের বিশদ বিবরণ। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এটি বিশ্বজাহানের অধিকর্তার পক্ষ থেকে এসেছে ।’
সূরা ইউনুস -৩৭

– ‘কিন্তু কোরআন আমি কেন মানবো? এটা দ্বারা তো প্রকৃতভাবে প্রমাণ হয়না যে কোরআন ঐশি গ্রন্থ । উপরন্তু কথাগুলি তো যে কেউ- ই চায়লে লিখতে এবং বলতে পারে । এ কথার কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তি কি তুমি দেখাতে পারবে ? ‘ – উনি কিছুটা উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করলেন ।

– ‘হ্যাঁ, তার প্রমাণ তো অবশ্যই আছে । আল্লাহ্ তায়ালা বলেছেন –

” তারা কি কুরআন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে না? যদি এটি আল্লাহ‌ ছাড়া আর কারো পক্ষ থেকে হতো, তাহলে তারা এর মধ্যে বহু বর্ণনাগত অসঙ্গতি খুঁজে পেতো । “
সূরা নিসা- ৮৩

এবার খেয়াল করুণ । রাসুল (সা.) যে সময়ে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন তখন ঐ যুগের আরবিয়ানদের সাহিত্যকলাই বিশ্বজুড়ে খুব নামডাক, যশ- খ্যাতি ছিল । তারা প্রচুর সাহিত্য চর্চা করতেন । ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় তখন উকাজের সাহিত্যমেলা নামে সাপ্তাহিক মেলা হতো যেখানে তৎকালিন আরবের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের সমাহার ঘটত এবং প্রতি সপ্তাহে নির্বাচিত সাতটি কবিতা সেখানে ঝুলন্ত করে রাখতেন । তখন ইমরুল কায়েসের মত উচু মানের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকগণ সাহিত্যসভার প্রতিনিধিত্ব করতেন । সেই যুগেই যখন তারা আল কোরআনের ভুল ধরতে উঠে পড়ে লাগলো তখন আল্লাহ তায়ালা সূরা বাকারার দুই নং আয়াতের মধ্যে বলেছেন, ” এটি আল্লাহর কিতাব, এর মধ্যে কোন সন্দেহ নেই । এটি হিদায়াত সেই ‘মুত্তাকী’দের জন্য । ”

এর প্রথম কথাটুকুর একটা সরল অর্থ এভাবে করা যায় “নিঃসন্দেহে এটা আল্লাহর কিতাব।” কিন্তু এর একটা অর্থ এও হতে পারে যে, এটা এমন একটা কিতাব যাতে সন্দেহের কোন লেশ নেই। দুনিয়ায় যতগুলো গ্রন্থে অতি প্রাকৃত এবং মানুষের বুদ্ধি-জ্ঞান বহির্ভূত বিষয়াবলী নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে সেগুলো সবই কল্পনা, ধারণা ও আন্দাজ–অনুমানের ভিত্তিতে লিখিত হয়েছে। তাই এ গ্রন্থগুলোর লেখকরাও নিজেদের রচনাবলীর নির্ভুলতা সম্পর্কে যতই প্রত্যয় প্রকাশ করুক না কেন, তাদের নির্ভুলতা সন্দেহ মুক্ত হতে পারেনা। কিন্তু এ কুরআন মজীদ এমন একটি গ্রন্থ যা আগাগোড়া নির্ভুল সত্য জ্ঞানে সমৃদ্ধ। এর রচয়িতা হচ্ছেন এমন এক মহান সত্তা, যিনি সমস্ত তত্ত্ব ও সত্যের জ্ঞান রাখেন। কাজেই এর মধ্যে সন্দেহের কোন অবকাশই নেই। মানুষ নিজের অজ্ঞতার কারণে এর মধ্যে সন্দেহ পোষণ করলে সেটা অবশ্য সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কথা এবং সেজন্য এ কিতাব দায়ী নয়।

আবার আল্লাহ তায়ালা একই যুগে অন্য আয়াতের মধ্যে বলেছেন,
” বলে দাও, যদি মানুষ ও জিন সবাই মিলে কুরআনের মতো কোন একটি জিনিস আনার চেষ্টা করে তাহলে তারা আনতে পারবে না, তারা পরস্পরের সাহায্যকারী হয়ে গেলেও। “
সূরা বানী ইসরাঈল – ৮৮

এবার বলুন, যে যুগে এত যুগপৎ সাহিত্যিকের সমাহার ঘটেছে, এত উঁচু মানের সাহিত্যজ্ঞান যারা চর্চা করত তারা কেন কোরআনের সব চাইতে ছোট সূরাটির মত একটি সূরা উপস্থাপন করতে সক্ষম হলোনা? কেন কোরআনের কোন সামান্য ক্রুটিও তারা বের করতে পারলোনা?
তখন থেকে এখন দেড় সহস্রবর্ষ পর্যন্ত অন্ততপক্ষে একজনতো পারত আল্লাহ তায়ালার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে । কিন্তু কোনো সাহিত্যিক, দার্শনিক, ধর্মপণ্ডিত, অথবা কোনো বিজ্ঞানী সেই দুঃসাহস করেননি। কিন্তু কেন করেনি?’

উনি কোনো উত্তর করলেন না তাই শিশির আবার বলতে আরম্ভ করল

– ‘উত্তর হলো – কোরআনে ভাষা-অলঙ্কার, কথা, যুক্তি, অদৃষ্ট-অদৃশ্য বিষয়গুলো এমন নিখুঁত ভাবে ব্যাবহার করা হয়েছে যে, তা এক বা একাধিক মানুষের জ্ঞানের সমন্বয়ে স্বাভাবিক হোক বা অস্বাভাবিক উভয় সেন্সে কোনভাবেই কারো পক্ষে এমন একটি গ্রন্থ, অথবা তার আংশিক, অথবা এর সবচাইতে ছোট সূরাটির মত একটি সূরাও রচনা করা সম্ভব নয় । এবং শত চেষ্টাই ও এই গ্রন্থের সামান্য একটি ক্রটিও বের করাও সম্ভব নয় ।
আর যদি তা সম্ভব হতো, তবে কী ইসলামের দুর্নামে লিপ্ত থাকা মক্কার সনামধন্য সাহিত্যিকগণ সে সুযোগ হাতছাড়া করতো? মুহূর্তেই তারা তা লুফে নিতো ইসলামের ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ে ।
এরপর ১৪০০ বছর ধরে অমুসলিম পণ্ডিতগণ চুপকরে থাকতো? – থাকতনা । এটা বুঝতে আশাকরি কোনো বিশেষ মস্তিষ্ক প্রয়োজন হবেনা
একটা সাধারণ মেধার মানুষও এই সহজ-সরল যুক্তিটি বুঝতে সক্ষম হবে ।
তো এসবের একটিইমাত্র কারণ আছে । আর তা হলো আল্লাহ্ তায়ালা ওয়াদা করেছেন সয়ং তিনি নিজেই এ গ্রন্থের সংরক্ষণকারী হবেন ।

এজন্য ক্রুটি তো দূরের কথা সবরকম সন্দেহ- সংশয় থেকে আল কোরআন ঊর্ধ্বে ।
এতে কিছু এক্সেপশোনাল শব্দ ব্যাবহার করা হয়েছে তা এত উঁচু মানের শব্দ এবং সুন্দর প্রাঞ্জলতায় অলঙ্কৃত যে- যে সেই শব্দটি শুধুমাত্র সেটির (কোরআনের) জন্যই উদ্ভূত ।
তাই যে ই কোরআন পড়ত- সেই
এর প্রেমে পড়ে যেত।

ইতিহাস পড়ে জানা যায় যে আবু জাহেল, আবু সুফিয়ান, উৎবা, সাহিবার মতো আরবের প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগন নিত্যরাতের আঁধারে সবার অগোচরে রাসূল (সা.) -এর সুললিত কণ্ঠে কোরআনমজিদ তেলাওয়াত শুনতে যেতেন । অথচ তারাই ছিলেন ইসলামের প্রত্যক্ষ শত্রু।
কিন্তু কেন? কোরআন যদি অসত্য হয় তবে তাদের কেন এতটান এর উপর? কেন তার প্রতিটি আয়াতের মনোমুগ্ধকর তেলাওয়াতের উপর তাদের এত দুর্বলতা?
কেন আজ ১৪০০ বছর পরেও এঁর প্রতিটি যের, যবর, নোক্তা পর্যন্ত অবিকৃত অবস্থায় থাকতে পারে?

উনি বেশ কিছুক্ষণ যাবত চুপচাপ মাথানিচু করে আছেন । হয়ত কি বলবে তা খুঁজে পাচ্ছেন না । কয়েক মুহূর্ত পরে তিনি মাথা তুলে তাকালেন শিশিরের দিকে
তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে আছে ওঁর মুখে। উনি একটু সময় নিলেন তারপর বললেন –

‘আচ্ছা তুমি তো বললে যে কোরআনমজিদে যাবতীয় সব কিছুই সন্নিবিষ্ট করা আছে তাই না?’

‘হ্যাঁ’

‘তাহলে বলোতো বিজ্ঞান সমন্ধে কিছু বলা আছে কি- না?’

‘হ্যাঁ অবশ্যই বলা আছে । কোরআনে প্রায় ১০০০ আয়াত আছে শুধুমাত্র বিজ্ঞান সমন্ধে । এবং এমন কিছু তথ্য আছে যা জ্ঞানিদের জন্য উত্তম নিদর্শন ।’ মুখে স্নিগ্ধ হাসি টেনে বলল শিশির। কতক্ষণ থেমে বড় একটা নিশ্বাস ফেলে আবার বলতে আরম্ভ করল

-‘বিজ্ঞানীরা একমত যে ,মহা বিশ্বে ছায়াপথ তৈরীর আগে আকাশ সম্পর্কিত পদার্থগুলো গ্যাস জাতীয় জিনিস ছিল।সংক্ষেপে বলতে গেলে, বিপুল সংখ্যক গ্যাসজাতীয় পদার্থ কিংবা মেঘ, ছায়া পথ তৈরীর আগে বিদ্যমান ছিল।আকাশ সম্পর্কিত প্রাথমিক পদার্থকে গ্যাস অপেক্ষা ধুঁয়া বলা বেশী সঙ্গত । কোরআন মজীদ ধুঁয়া দ্বারা মহাবিশ্ব সৃষ্টির ঐ অবস্থার প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

” তার পর তিনি আকাশের দিকে মনোযোগ দিলেন যা কিছু ধূঁম্রকুঞ্জ, অতঃপর তিনি তাকে ও পৃথিবী বললেন, তোমরা উভয়ে আস ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। তারা বলল আমরা সেচ্ছায় আসলাম। “
– সূরা হা-মীম সাজদাহ-১১

এছাড়া

মহান আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন-
” অতএব, মানুষের দেখা উচিত কি বস্তু থেকে সে সৃজিত হয়েছে। সে সৃজিত হয়েছে সবেগে স্খলিত পানি থেকে।এটা নির্গত হয় মেরুদণ্ড বক্ষপাঁজরের মাঝ থেকে। “
(সূরা তারেক -৫-৭)

এখন আধুনিক বিজ্ঞানের কথা হলো-

” জন্মপূর্ব বিকাশের স্তরে,পুরুষ ও নারীর জনেন্দ্রীয়গুলো,অর্থাৎ পুরুষের অন্ডকোষ এবং নারীর ডিম্বাশয়,কিডনীর কাছে মেরুদণ্ড স্তম্ভ এবং ১১শ ও ১২শ বক্ষপাঁজরের মাঝে বিকশিত হয়।তারপর সেগুলো নীচে নেমে আসে।নারীর ডিম্বাশয় তলপেটে এসে থেমে যায়।

কিন্তু জন্মের আগ পর্যন্ত পুরুষের অণ্ডকোষ উরুর গোড়ার নালী দিয়ে অণ্ডকোষের থলিতে নেমে আসার ধারা অব্যাহত থাকে । এমনকি জনেন্দ্রীয় নীচে আসার পর কৈশোরেও গুলো পেটের বড় ধমনী থেকে স্নায়ু ও রক্ত সরবরাহ লাভ করে । আর সেগুলোর অবস্থান হল মেরুদণ্ড এবং বক্ষপাঁজরের মাঝখানে । রসবাগী নালী এবং শিরাগুলোও একই এলাকার গিয়ে মিলিত হয় “

যেগুলো বললাম এগুলো সব আধুনিক বিজ্ঞানের সম্প্রতি আবিষ্কার । কিছু আবিষ্কার আছে বড়জোর দু’শো বছর আগেকার । তাহলে আমার প্রশ্ন হলো, আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে একজন মানুষ কিভাবে তার নিখুঁত ভবিষ্যৎবাণী করতে পারে?

তাও আবার একটি দুটি নয় অসংখ্য আয়াত -নিদর্শন ।
আপনাকে একটি কথা বলে রাখি তা হলো, রাসূল (সা.)
দুনিয়াবি কোন শিক্ষা গ্রহণ করেননি । আল্লাহ তায়ালা ৪০ বছর বয়সে হেরা গুহাতে প্রথম তাঁকে শিক্ষা দেন সূরা আল আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত । সেদিন থেকেই তাঁর শিক্ষা শুরু ।
তো যা বলছিলাম, আপনাদের প্রতিক্ষিত বিজ্ঞান সম্প্রতি যা আবিষ্কার করেছে তা একজন মানুষের পক্ষে আজথেকে দেড় হাজার বছর আগে এমন নিখুঁতভাবে বিশ্লেষণ করা কি আদৌ সম্ভব? যদি হয়েও থাকে তবে তা কিভাবে সম্ভব?
বস্তুতঃ এগুলো শুধুমাত্র তাঁর দ্বারাই বলা সম্ভব যিনি বিশ্ব জগতের সৃষ্টিকর্তা, যিনি অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল।

এপর্যন্ত বলে শিশির থামলো। তারপর বেঞ্চ থেকে উঠে ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে একটু সামনে গিয়ে অন্যদিকে ফিরে দাঁড়ালো । সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে ।
দিনের আলোকে এখনই সায়াহ্নের আঁধার স্পর্শ করল বলে ।
ওদিকে ঐ লোকটি একদম চুপচাপ বসে আছেন । উনার দৃষ্টি নিবদ্ধ নিচের দিকে ধুলিকণার আকস্মিক নড়ে চড়ে ওঠার দিকে যা হয়েছে এখনই তার চোখ থেকে টপটপ করে ঝরে পড়া জলের ফলে । উনি কোন বিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তামগ্ন । চিন্তা- কল্পনার মধ্য দিয়ে উনি প্রবেশ করেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতে। তার কানে স্মিত প্রতিধ্বনি হয়ে বাজতে লাগল শিশিরের কণ্ঠে কিছুক্ষণ আগে শোনা পবিত্র কোরআনুল কারিমের আয়াতগুলো। মনে আন্দোলিত হতে লাগলো সেই আয়াতের সূর- সেই মুগ্ধতা মিশ্রিত অখণ্ডনীয় যুক্তি। ভীতি মিশ্রিত খুশির তীব্র জোয়ার আছড়ে পড়তে লাগলো তার হৃদয় সমুদ্রতটে।

কয়েক মুহূর্তের শুনশান নীরবতা । পিছন থেকে শিশিরের কাঁধ স্পর্শ করল একটি কম্পিত হাত । শোনা গেলো একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস পতিত হওয়ার সাথে কান্নাভেজা কণ্ঠস্বর । কিছুটা অস্ফুট আর্তনাদের মতো শোনাগেল।

– ‘বাবা, আমি আমার জীবনের বেশিরভাগ সময় অতিবাহিত করেছি স্রষ্টার অবাধ্যতা, অবিশ্বাস করে । তোমার কণ্ঠে শোনা আরবি শব্দগুলোর অর্থ আমি না জানলেও বিশ্বাস করো তা আমার হৃদয়ে আন্দোলিত করছিলো । এক স্নিগ্ধ পবিত্রতা ছুঁয়ে যাচ্ছিল আমাকে । এমন নমনীয়তা আমি কখনওই অনুভব করিনি । তারপর কথাগুলির অর্থ আর বিজ্ঞান ভিত্তিক, না না বিজ্ঞানের চাইতেও ঊর্ধ্বতর কিছু কথা শোনার পর আমার শরীর কেন জানি কম্পিত হচ্ছে । দূরে চলে যাচ্ছে সব অবিশ্বাস
। আর প্রবল আকাঙ্খা এসে ভর করছে স্রষ্টার সান্নিধ্য পাওয়ার, সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী হওয়ার । আমি জানতে চাই আমার মত অবাধ্য মানুষকে কী তোমাদের স্রষ্টা তার সৃষ্টি হিসেবে গ্রহণ করবেন? ক্ষমার সুদৃষ্টি কি পেতে পারি আমি?’

উনি চোখ বড়বড় করে উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকালেন শিশিরের দিকে । শিশির উনার চাইতে বেশি বিস্মৃত হলো । ওঁর স্নায়ুতন্ত্রী জুড়ে বয়ে গেল অভূতপূর্ব এক আনন্দশ্রোতের স্নিগ্ধ ঢেউ । তার চোখ আটকে গেল মানুষটার মুখে । আল্লাহ বুঝি এভাবেই তার পছন্দমত মানুষদের সত্য- সঠিক আলোর পথ প্রদর্শন করেন! তারকাছে একজন সত্যিকারের সফল মানুষ বলে মনে হলো উনাকে । যে
আল্লাহ তায়ালার রহমত প্রাপ্ত হয়ে হেদায়েতের দীপ্ত আলোয় আলোকিত হয়েছেন ।
শিশির মুখে একমুঠো পবিত্র হাসির রেখা এঁকে বললো,
‘যখন কোন পথহারা ব্যক্তি তার ভুল বুঝতে পেরে আল্লাহর পথে ফিরে আসে তখন তিঁনি এতই খুশি হন যেমনটা একজন মা তার হারানো সন্তান ফিরে পেলে খুশি হয় । আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বান্দা তোমার গোনাহ্ যদি হয় পাহাড় সমপরিমাণ তবুও বিচলিত হয়ো না। তোমার রবের অঢেল রহমত হলো আকাশচুম্বী । তোমরা সেই রহমত থেকে দূরে সরে যেওনা ।’

চোখে জল তবুও মুখে ঈমানদীপ্ত হাসি নিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরলেন শিশিরকে । তারপর বলতে লাগলেন, ‘আমি কখনও কোরআন পড়িনি, না পড়েই শুধু বিভ্রান্তিকর যুক্তিতে সম্মোহিত হয়ে নাস্তিক্যকে বরণ করে নিয়ে ছিলাম । আমি ভেবেছিলাম কোরআন একটি সাধারণ গ্রন্থ । কিন্তু এখন বুঝতে পারছি যারা নাস্তিকতা করে তাদের অন্ততপক্ষে কোরআনকে এড়িয়ে যাওয়া নয় বুঝে পড়া উচিৎ ।
কোন কিছুর বিরুদ্ধে কাজ করতে হলেও তো তা সম্পর্কে জানতে হয়। অন্তত সেজন্যে হলেও তাদের পবিত্র কোরআনকে বুঝে পড়া উচিৎ। যদি কেউ এঁটি অনুধাবন করে পড়ে তবে তারা সত্যিকার অর্থে সত্যকে রিয়ালাইজ করতে পারবে ।’

‘আলহামদুলিল্লাহ্‌! সুন্দর আপনার চিন্তা, সুন্দর আপনার অভিব্যক্তি। আল্লাহ হয়ত আপনাকে দিয়ে ইসলামকে অনেকটা দূরে নিয়ে যাবেন।’

– ‘ধন্যবাদ! আমাকে কিভাবে ইসলামে প্রবেশ করতে হবে? নির্দিষ্ট কোন উপায় আছে নাকি?’ বললেন উনি।

উনার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটুকরো হাসল শিশির। তারপর বলল, ‘ জি অবশ্যই। ইসলামে প্রবেশের সিংহদ্বার হলো কালিমা। যার অর্থ আল্লাহকেই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রিঝিকদাতা, বিধান দাতা হিসেবে মেনে নেওয়া এবং মুহাম্মদ (সা.) কে তার প্রেরিত দূত হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। এগুলো করার মধ্য দিয়ে যে কেউই মুসলিম হতে পারে। আর পরিপূর্ণ বিধান মানার মাধ্যমে পূর্ণ মুসলিম বা আল্লাহ তায়ালার প্রিয়বান্দা হতে পারেন।’

শিশিরের কথাশোনার পর উনার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
উনি উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বললেন, ‘তাহলে আমি মনে প্রাণে এসবকিছু মেনে নিলাম এবং স্বীকৃতি দিলাম।’

– ‘ আলহামদুলিল্লাহ্‌! শিশির বলল, ‘আপনি কিন্তু এখনো আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তরটি এখনও পাননি । আর কেউ তার প্রশ্ন ভুলেগেলে আর আমি উত্তর করতে না পারলে মনটা তখন থেকেই আকুলিবিকুলি করতে থাকে ।’

– ‘ওহ্ আচ্ছা তাই? তো কি বলতে বাকি আছে বলে ফেলো ।’

– ‘মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনহাকিমের মধ্যে বলছেন যে

” আর আল্লাহই বায়ুকে নিজের অনুগ্রহের পূর্বাহ্নে সুসংবাদবাহীরূপে পাঠান । তারপর যখন সে পানি ভরা মেঘ বহন করে তখন কোন মৃত ভূখণ্ডের দিকে তাকে চালিয়ে দেন এবং সেখানে বারি বর্ষণ করে (সেই মৃত ভূখণ্ড থেকে) নানা প্রকার ফল উৎপাদন করেন । দেখো, এভাবে আমি মৃতদেরকে মৃত্যুর অবস্থা থেকে বের করে আনি । হয়তো এ চাক্ষুষ পর্যবেক্ষণ থেকে তোমরা শিক্ষা লাভ করবে । “
সূরা আরাফ- ৫৭

আলহামদুলিল্লাহ্‌ সমাপ্ত

আলোক পথের অভিযাত্রী

Share with Friends

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top